রাজধানীর নামীদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবৈধ শাখা বাণিজ্য

নূর মোহাম্মদ: রাজধানী সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় একটি শাখার অনুমোদন রয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটি গুলশান, উত্তরা, মিরপুরসহ রাজধানী বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষাবোর্ডের অনুমোদনবিহীন একাধিক শাখা ক্যাম্পাসে চালাচ্ছে। মনিপুর স্কুল মূল শাখার উচ্চ মাধ্যমিক ও রাজধানী আরও তিনটি শাখার একটিও অনুমোদন নেই। একই অবস্থা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের। ওই প্রতিষ্ঠানটি বনশ্রী শাখা ও শতাধিক শ্রেণি শাখার অনুমোদন নেই। ঐতিহ্যবাহী ভিকারুননেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অনুমোদিত শ্রেণি শাখা রয়েছে মাত্র ২০টি। অথচ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ছয় শতাধিক শ্রেণি শাখা চালাচ্ছে।

শুধু এ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, সারাদেশে এভাবে বিপুল সংখ্যক স্কুল-কলেজের অনুমোদনহীন শাখা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাড়াঁশি অভিযানে নেমেছে শিক্ষাবোর্ড। প্রথমে শোকজ, জবাব সন্তষ্টজনক না হলেও পর্যায়ে একাডেমিক ও পাঠদানের স্বীকৃতি বাতিল করা হচ্ছে। শিক্ষাবোর্ড ও অসুন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ধারাবাহিকা কাজের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন সংক্রান্ত নথি ঘাটতে গিয়ে ‘কেঁচো খুড়তে সাপ বের হয়ে আসার মতো অবস্থা’। রাজধানী নামিদামী অনেক প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্রাঞ্চের অনুমোদন নেই। মন্ত্রণালয়ের আবেদন করেছে সেই আবেদন দিয়েই ব্রাঞ্চ খুলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। ভিকারুননেসা মতো স্কুলে মাত্র ২০টি শ্রেণি শাখার অনুমোদন দিয়ে তিনটি শাখায় ২৫ হাজারে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্কুল কলেজের এরকম ভুইফোড় শাখার সন্ধান পেয়েছে তারা। এরই অংশ হিসেবে গত ১১ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়েছে ৩৩টি শিক্ষাপ্র্রতিষ্ঠানের নি¤œ মাধ্যমিক স্তরের অনুমতি না থাকায় চলতি শিক্ষা বর্ষের অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের অনলাইনে নিবন্ধন পাস ওয়ার্ড বন্ধ করেছে দিয়েছে ঢাকা বোর্ড। একই পরিস্থিতির শিকার হবেন একাদশ পর্যায়ে কলেজগুলো। আসন্ন কলেজ পর্যায়ে ভর্তিতে অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বন্ধ করে দিবে শিক্ষাবোর্ড।

এ ব্যাপারে ঢাকা শিক্ষাবোর্ড ও আন্তঃশিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক আইএনবিকে বলেন, বেআইনিভাবে চালানো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট শাখাকে বলেছি। তারা এ ধরণের প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করে যখনই আমাদের নজরে আসছে তখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। এত বছর কি ভাবে চলছে এমন-প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, সে ব্যাখ্যা আমি দিতে পারবো না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ ধরণের কোন ঘটনা ঘটছে না। আমরা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন শাখা অনুমোদন দিচ্ছি না।

ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের স্কুল ও কলেজ শাখা সূত্রে জানা গেছে, অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে রাজধানী মিরপুরে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চবিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটি কলেজে উন্নীত করা হয়। ২০১১ সালে ইংরেজি মাধ্যম চালু করা হয়। পরবর্তিতে পর্যায়ক্রমে রূপনগর, ইব্রাহিমপুর ও শেওড়াপাড়ায় তিনটি শাখা ক্যাম্পাস খোলে। চলতি শিক্ষাবর্ষে মূল ক্যাম্পাসে সাড়ে ১৪ হাজার, রূপনগর শাখায় সাড়ে ৭ হাজার, ইব্রাহিমপুর ও শেওড়াপাড়া শাখায় যথাক্রমে সাড়ে পাঁচ হাজার ও সাড়ে ছয় হাজার শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছে। প্রথম শাখা ক্যাম্পাস খোলার কোন আবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে নেই। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শাখা ক্যাম্পাস খুলতে ঢাকা বোর্ডে স্কুল কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বোর্ডের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শণ শেষে ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায়। মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই শেষে ২০১২ সালের ২ এপ্রিল আবেদনটি বাতিল করে দেয়। মন্ত্রণালয় শাখা ক্যাম্পাস খোলার অনুমোদন না দিলেও থেমে থাকেনি শিক্ষা কার্যক্রম। ঢাকা বোর্ড ও অভিভাবকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, অবৈধ এসব ক্যাম্পাসে চলতি শিক্ষাবর্ষে সাড়ে ১৯ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছে। প্রত্যোকের কাছ থেকে বছরের শুরুতেই ৮ হাজার টাকা করে টিউশনি আদায় করা হয়েছে। এ খাতে এক বছরে ১৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা আদায় করেছে। আর শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন সাড় ১৩ টাকার পরিবর্তে এ বছর ১৪ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বেতন বাবদ মাসিক ২৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা বাণিজ্য করছে।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি শাখা ১৯৯৬ সালে রামপুরা থানার বনশ্রী প্রতিষ্ঠান করা হয়। এ শাখাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই চলছে। ২০১৪ সালে ১০তলা একটি ভবন করা হয়েছে সরকারি টাকায়। একই শাখায় বাংলা ভার্সনের পাশাপাশি ইলিশ ভার্সনেও পাঠদান চলছে। অনুসন্ধান বোর্ডের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এ প্রতিষ্ঠানের বনশ্রী শাখার কোন অনুমোদন নেই। এছাড়া মতিঝিল মূল ক্যাম্পাসের ১০৫টি শ্রেণি শাখার মধ্যে ৩২টি ও মুগধা শাখার ৫৬টি অতিরিক্ত শ্রেণি শাখার অনুমোদন নেই। প্রতি বছর এসব অবৈধ শাখা ক্যাম্পাস ও শ্রেণি শাখায় শিক্ষার্থী ভর্তি করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালে ভর্তি পরীক্ষার খাতা জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বর্তমানে অধ্যক্ষের এমপিও স্থগিত আছে। এর আগেও একবার তার এমপিও স্থগিত করা হলে উচ্চ আদালতে মামলা করে সরকারি বেতন-ভাতা সচল করেন।
ঢাকা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ভিকারুননেসা প্রতিটি ব্রাঞ্চ ও শ্রেণিভিত্তিক শাখা ও শিক্ষার্থীর তথ্য ১২ ফেব্রুয়ারি মধ্যে দিতে চিঠি দিলেও প্রতিষ্ঠানটি গতকাল সোমবার পর্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়নি। এ প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার দিবা ও প্রভাতী শাখার ১০টি করে মাত্র ২০ শ্রেণি শাখার অনুমোদন আছে। বাকিগুলো অবৈধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ২৫ হাজার শিক্ষার্থী পাঠদান করছে। এ হিসেবে অন্তত ৬২৫টি অতিরিক্ত শাখা দরকার। ভর্তি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী একটি শাখা সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে। এর অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করতে হলে মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত শ্রেণি শাখা পরিচালনার অনুমোদন নিতে হবে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের নিন্ম মাধ্যমিক শাখার অনুমোদন ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

রাজধানীতে শিক্ষা বাণিজ্যে ধারা শূরু করেছে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে গুলশান-১ এর ২২ নম্বর সড়কে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। পরবর্তিতে শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে একই এলাকার ৩ নম্বর সড়কে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৭ সালের ৪ জুলাই বোর্ডের অনুমতি পত্রে তিনটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। শর্তগুলো হলো-বোর্ডের অনুমতি ছাড়া ঠিকানা পরিবর্তন করা যাবে না, আগামী দুই বছরের মধ্যে নিজস্ব জমি ও ভবনের ব্যবস্থা করতে হবে। কলেজ ভবনের কোন অংশই অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বোর্ডের তৎকালীন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটি গুলশান হতে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় স্থানান্তরিত করা হয়। নতুন অনুমোদনে আগের প্রথম দুটি শর্ত বহাল রাখা হয়। কিন্তু এই শর্ত লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে গুলশান, উত্তারা, মিরপুর, বারিধারায় অবৈধভাবে শাখা ক্যাম্পাস খুলে শিক্ষা বাণিজ্য করছে।

এ ব্যাপারে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হামিদা আলী আইএনবিকে বলেন, বোর্ডের শোকজের জবাব দেয়া হয়েছে। বাকী বিষয়গুলো চারজন্য অধ্যক্ষ আছে তারাই ভাল বলতে পারবেন। এ ব্যাপারে একটি শাখার অধ্যক্ষ উইং কমান্ডার (অব.) আমজাদ হোসেন বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান একই নামে বিভিন্ন ব্রাঞ্চ চলছে, আমরাও সেভাবে চালিয়েছি। এখন আলাদা অনুমোদন নিতে হবে জানার পর সেভাবেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আবেদন করেছি। এতদিন অনুমোদন ছাড়া ব্রাঞ্চ চললো কীভাবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সবই মূল ব্রাঞ্চের অধীনে চলেছে।

ঢাকা শিক্ষাবোর্ড ও আন্তঃ শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ আইএনবিকে বলেন, সারাদেশে কলেজগুলোর অনুমোদন সংক্রান্ত নথি যাচাই করতে গিয়ে রীতিমত ‘থ’ হয়ে গেছি। শুধু একটি আবেদন করেই তিনটি ব্রাঞ্চ খোলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছি। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাড়াঁশি অভিযান চলছে। এছাড়াও শাখা, শ্রেণি শাখা, কমিটি, অতিরিক্ত ফি আদায়সহ নানা ক্যাটাগরিতে ভাগ করে যাচাই বাচাই চলছে। যারাই নিয়মের বাইরে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের ধরা হচ্ছে।

মাধ্যমিক পর্যায়ে একই ধরনের অভিযান চলছে। ঢাকা বোর্ডের স্কুল পরিদর্শক মোহাম্মদ আবুল মনছুর ভূঞা গত ১১ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়েছে ৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিম্ম মাধ্যমিক স্তুলের অনুমতি না থাকায় চলতি শিক্ষা বর্ষের অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের অনলাইনে নিবন্ধন পাস ওয়ার্ড বন্ধ করেছে দিয়েছে ঢাকা বোর্ড। এ ব্যাপারে স্কুল পরিদর্শক বলেন, কলেজের অনুমোদন নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করলেও নিম্মমাধ্যমিক স্তরের অনুমতি ছাড়াই শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিম্মমাধ্যমিক স্তুরের পাঠদানের অনুমতি না থাকায় নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।