আন্তর্জাতিক ডেস্ক:অবরুদ্ধ মারিউপোল শহরে থাকা ইউক্রেনিয়ান বাহিনীর অধিনায়ক এক ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেছেন, যে বার্তায় ভিডিওটিকে ‘বিশ্বের প্রতি শেষ বার্তা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
সেখানে ইউক্রেনিয়ান বাহিনীর অধিনায়ক বলেছেন, তারা আর মাত্র কয়েকদিন বা কয়েক ঘণ্টা হয়তো টিকে থাকতে পারবেন।
ওই বার্তায় মেজর সেরহিভ ভলিয়ানা জানান, তাদের জরুরি সরবরাহ শেষ হয়ে আসছে ও রুশ সেনারা তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে।
ইউক্রেনের সেনাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য রুশ বাহিনীর বেঁধে দেওয়া শেষ সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত আত্মসমর্পণের কোনও অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
মারিউপোলের ইউক্রেনিয়ান সেনারা এখন আজভস্টাল ইস্পাত কারখানার ভেতর কোণঠাসা হয়ে আছে। সেখানে তাদের সঙ্গে এক হাজারের মতো বেসামরিক নাগরিকও রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইউক্রেনের সরকার অবশ্য বলছে, মারিউপোল থেকে বেসামরিক মানুষদের উদ্ধারে রাশিয়ার সঙ্গে একটা সমঝোতা হয়েছে।
মারিউপোলের মেয়র ভাডিম বোইচেংকো জানিয়েছেন, ছয় হাজার মানুষকে উদ্ধারের জন্য সেখানে ৯০টি বাস পাঠাবে ইউক্রেন। তিনি বলেন, প্রায় এক লাখ মানুষ এখনI শহরে আটকে আছে।
তবে প্রাদেশিক গভর্নর পাভলো কিরিলেঙ্কো জানিয়েছেন, প্রাথমিক পরিকল্পনার চেয়ে কম সংখ্যক বাস অবরুদ্ধ বেসামরিক নাগরিকদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে এবং খুব বেশি মানুষ সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “পূর্ব নির্ধারিত পয়েন্টে মানুষ জড়ো হলেও অল্প সংখ্যক মানুষই বাসে উঠতে পেরেছেন।”
মারিউপোল শহরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত আযভস্টাল ইস্পাত কারখানাটির আয়তন প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার – যেটি এখন ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের সর্বশেষ ঘাঁটি। এটির পতন ঘটলে পুরো মারিউপোল রুশদের হাতে চলে যাবে।
কী পরিমাণ ইউক্রেনীয় সেনা শহরটিতে আছে, তা পরিষ্কার না হলেও বিবিসিকে পাঠানো ভিডিও বার্তায় মেজর ভলিয়ানা বলেন যে ইস্পাত কারখানায় প্রায় ৫০০ আহত সেনা সদস্যকে সেবা দেয়া হচ্ছে।
৩৬ মেরিন ব্যাটেলিয়নের প্রধান মেজর ভলিয়ানা ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন যে তার বাহিনীর রসদ শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং ভিডিওটিকে ‘বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের শেষ বার্তা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
রুশ সৈন্যরা যখন ধীরে ধীরে মারিউপোলে ঢুকতে শুরু করে, তখন এই বিশাল ইস্পাত কারখানা এলাকার দিকে সরে যায় হাজার হাজার ইউক্রেনীয় সেনা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আজভ ব্যাটালিয়নও। এই বিতর্কিত জাতীয় রক্ষী বাহিনী ইউনিটের সঙ্গে কট্টর দক্ষিণ-পন্থী গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক আছে।
কারখানা এলাকার ভেতর মাটির নীচে বহু টানেল এবং ওয়ার্কশপ আছে, ফলে সেখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালানোর কিছু সুবিধা আছে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী ডোনেটস্ক অঞ্চলের একজন কর্মকর্তা ইয়ান গাগিন রাশিয়ার সরকারি বার্তা সংস্থা রিয়া নোভোস্তিকে জানিয়েছেন, এই বিশাল ইস্পাত কারখানার নীচে লুকিয়ে আছে কার্যত আরেকটি শহর।
বেসামরিক করিডোর
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, রুশ বাহিনীর বোমায় প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া মারিউপোল শহরে এখনও প্রায় এক লাখ বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন।
মারিউপোল শহরে মানবিক করিডোর তৈরির একাধিক প্রচেষ্টা এর আগে ব্যর্থ হয়ে গেছে। রাশিয়া আর ইউক্রেন দুই পক্ষেই একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব না মানার পাল্টা অভিযোগ তুলেছে।
তবে ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেসচুক জানিয়েছেন যে মারিউপোল থেকে ছয় হাজার মানুষ সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মস্কো।
এর আগে ইউক্রেন অভিযোগ তুলেছিল যে মারিউপোল থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে রুশ বাহিনী।
মারিউপোলে কেন জড়ো হয়েছে রুশ সৈন্যরা?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতরের হিসেব অনুযায়ী, রাশিয়া ইউক্রেনে ৭৬টি ট্যাকটিক্যাল ব্যাটালিয়ন গ্রুপ পাঠিয়েছে, তার প্রায় ১২ টি এখন মারিউপোলে যুদ্ধ করছে। যদি মারিউপোলের পতন ঘটে, তখন সেখান থেকে রাশিয়া তাদের ১০ হাজার সৈন্যকে ডোনবাস অঞ্চলের অন্যান্য জায়গায় লড়াইয়ের জন্য পাঠাতে পারবে।
মারিউপোল দখল করতে পারলে রাশিয়া তাদের দখলে থাকা ক্রিমিয়া অঞ্চলকে রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে থাকা পূর্ব ইউক্রেনের এলাকাগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে পারবে। এর ফলে ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগর উপকূলের ৮০ শতাংশই আসলে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ইউক্রেন তখন কার্যত বাকি বিশ্ব থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, সমুদ্র পথে তাদের বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।
এটিকে প্রেসিডেন্ট পুতিন একটি বড় বিজয় হিসেবে দেখিয়ে প্রোপাগান্ডা চালাতে পারবেন।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া এ পর্যন্ত একটি মাত্র বড় শহর, খেরসন দখল করতে পেরেছে। মারিউপোল দখল করতে পারলে প্রেসিডেন্ট পুতিন তার দেশের জনগণকে দেখাতে পারবেন যে রাশিয়া যে লক্ষ্য নিয়ে সেখানে গেছে, তা অর্জিত হচ্ছে।
অন্যদিকে আজভ ব্যাটালিয়নকে ধরতে পারলে প্রেসিডেন্ট পুতিন দাবি করতে পারবেন যে, ইউক্রেনিয়ান সরকার নাৎসিদের হাতে চলে গেছে, যেরকম একটা দাবি তিনি অনেকদিন ধরেই করে যাচ্ছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা
আইএনবি/বিভূঁইয়া