ভারতের চন্দ্র অভিযানের নেপথ্যে ‘রকেট নারী’

প্রযুক্তি ডেস্ক: গত বুধবার সন্ধ্যায় আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের পর চতুর্থ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের চন্দ্রে অবতরণ ও একইসাথে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে পদার্পণের সাফল্যে সারা পৃথিবী উত্তাল হয়ে উঠেছে।

এশিয়ার একটি দেশে যেখানে আজো অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যরেখার নিচে বসবাস করছেন বা যেখানে আজো সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের সমঅধিকার অর্জিত হয়নি, সেখানে চন্দ্রবিজয় কতটা যুক্তিযুক্ত এমন নানা প্রশ্নের ভেতরেও মাত্র ছয়শ কোটি টাকা ব্যয়ে, আন্তরিক দেশপ্রেমে ভর করে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় তরুণ-তরুণী বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের কঠোর শ্রমে এই সাফল্য অর্জন করেছে ভারত।

গত পরশু ভারতীয় স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে ‘চন্দ্রযান-৩’ এর ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে।

উল্লেখ্য, চাঁদের এই দক্ষিণ মেরুতেই বরফ, পানি অথবা জমাটবদ্ধ বরফ আছে। ফলে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অক্সিজেন ও জ্বালানি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যা ভবিষ্যতে সেখানে মানববসতি গড়ার পক্ষে অনুকূল হতে পারে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের জন্য রাশিয়া লুনা-২৫ নামের একটি মহাকাশযান পাঠালেও গত শনিবার এটি চাঁদে বিধ্বস্ত হয় যা বিগত ৪৭ বছরে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার কোনো চন্দ্রাভিযানকে ব্যর্থ করে দেয়। ইতোপূর্বে ২০১৯ সালে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে অবতরণের উদ্দেশ্যে ভারত তার ‘চন্দ্রযান-২’ পাঠালেও সেবার অভিযানটি সফল হয়নি। গত ১৪ জুলাই ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশকেন্দ্র থেকে ‘চন্দ্রযান-৩’ মহাশুন্যে পাঠানো হয়। ‘চন্দ্রযান-৩’ এর ল্যান্ডারের নাম ‘বিক্রম’ এবং রোভারের নাম ‘প্রজ্ঞান’। ল্যান্ডারটি উচ্চতায় ২ মিটারের মতো, ওজন ১৭০০ কেজির বেশি। আয়তনে ক্ষুদ্রাকৃতি রোভারের ওজন মাত্র ২৬ কেজি। এই রোভারই চাঁদের বুকে ঘুরে ঘুরে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাবে।

ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন (ইসরো) গত বুধবার ভারতীয় স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে তাঁদের বিজয় নিশান ওড়াতে সক্ষম হয়। ইসরোর প্রধান এস সোমনাথ এই গৌরবমণ্ডিত মুহূর্তকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘ভারত এখন চাঁদে উঠেছে।’

ইতোমধ্যে সবাই অবগত যে ‘চন্দ্রযান-৩’ হচ্ছে চাঁদে ভারতের তৃতীয় অভিযান। চাঁদে ভারতের ‘লঞ্চ ভেহিকল মার্ক-৩ (এলভিএম-৩)’ ব্র্যান্ডের যে মহাকাশযানটি পাঠানো হয়েছে তার নাম ‘চন্দ্রযান-৩।’ দেশের বৃহত্তম রকেট দ্বারা প্রায় ৩,০০০ কিলোমিটারের চেয়েও আয়তনে বড় এই মহাকাশযানটিকে পৃথিবীতে অবতরণের জন্য ১৭০x৩৬,৫০০ কিলোমিটারের দূরত্বসহ উপ-বৃত্তাকার কক্ষপথে চালু করা হয়েছে।

চাঁদের উদ্দেশ্যে এই দীর্ঘ চন্দ্রযাত্রা ১৪ জুলাই শুরু হয়। গত ২৩ আগস্ট, বুধবার চাঁদে এই চন্দ্রযানের সফল সফট ল্যান্ডিং-এর মাধ্যমে ভারত মহাকাশ বিজ্ঞানে সম্মুখসারির একটি রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। একইসাথে ভারত পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ তথা চাঁদে সফলভাবে রোবোটিয় অনুসন্ধানকারী চতুর্থ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো, আত্মপ্রকাশ করলো চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথম অবতরণকারী দেশ হিসেবেও।

‘চাঁদের দক্ষিণ মেরু কতটা ‘রহস্যময়?’
নাসার মতে, চাঁদের দক্ষিণ মেরু হচ্ছে ‘রহস্য, বিজ্ঞান এবং মুগ্ধ হবার মতো বিষ্ময়ে ভরপুর।’

কয়েকটি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ এবং গভীর নয়নজুলির গর্তসহ চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ভূ-প্রকৃতি যথেষ্ট দুর্গম। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কোন কোন জায়গায় তাপমাত্রা লক্ষ কোটি বছর সূর্যের উত্তাপ এসে পৌঁছতে না পারার কারণে ২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও কম। ইতোমধ্যে বেশ কিছু গভীর ছায়াঘেরা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে পানির অস্তিত্ব বেশ কিছু গবেষণা সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে। আর চন্দ্র-পৃষ্ঠে পানির এই উপস্থিতিই পৃথিবীর বেশকিছু জাতিকে এই অপরিজ্ঞাত এলাকায় নব অভিযানে প্রেরণা যুগিয়েছে। এই এলাকা ঘিরে তাই বৈজ্ঞানীক কৌতূহলের শেষ নেই। আগ্নেয়গিরির এই জ্বালামুখগুলো সর্বক্ষণই ছায়াচ্ছন্ন এবং শীতল জলে ভরা। ভবিষ্যতে আরো বেশি বেশি মানবীয় অভিযানের জন্য এই এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ নানা সম্পদে পরিপূর্ণ বলে নাসার আর্টেমিস মিশন মনে করেন যারা এই দক্ষিণ মেরু এলাকায় সামনে নভোচারীও পাঠাতে যাচ্ছেন।

এসব বৈজ্ঞানিক তথ্য পত্র-পত্রিকায় আসার সাথে সাথে আমাদের সবারই বিষ্ময়ের পারদ সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছালো যখন আমরা জানতে পারলাম যে ভারতের এবারকার ঐতিহাসিক ‘চন্দ্রাবতরণ’ (চন্দ্রায়ন-৩) এর টিমে ৫৪ জন ভারতীয় নারী বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের সম্মিলিত মেধা ও শ্রমের পাশে গোটা মিশনের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব প্রদানকারীদের অন্যতম এবং গোটা মিশনের সব ধরনের কাজের পেছনের নিভৃত ব্যক্তিটি হচ্ছেন ড. রীতু কারিধাল শ্রীবাস্তব।

নিচে ভারতের ‘চন্দ্রযান-৩’ এর সম্মুখসারির কিছু নারী বিজ্ঞানীর পরিচিতি তুলে ধরা হলো:

ড. রীতু কারিধাল শ্রীবাস্তব
জন্ম: ১৯৭৫। মধ্য-সত্তরের দশকে জন্ম নেওয়া রীতু লাখনৌয়ের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের চার সন্তানের ভেতর জ্যেষ্ঠতম ছিলেন। পরিবারের সীমিত আর্থিক সাধ্যেই ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করানোর গুরুত্ব বাবা-মা বুঝতেন। ‘আমাদের খুব বেশি টাকা-পয়সা ছিল না। আর সেই সময় এত টিউশনি বা কোচিং প্রতিষ্ঠানও ছিল না। সফল হতে হলে আত্ম-উদ্যমী হতে হতো, রীতু বলেন গুগল ইন্ডিয়াকে।

কিশোরী রীতুর শখ ছিল সংবাদপত্রে নাসা এবং ইসরোর গবেষণা নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন কেটে রাখা। এছাড়া গণিত ও পদার্থবিদ্যা পড়তেও তিনি খুবই ভালোবাসতেন। বিশেষত: গণিত তাঁর এত ভালো লাগতো যে এ বিষয়ে তিনি কবিতাও লিখতেন।

স্বপ্নের কাছাকাছি
লাখনৌ বিশ্ববিদ্যালয় বা ইউনিভার্সিটি অফ লাখনৌ-এর মহিলা বিদ্যালয় পিজি কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে রীতু ইউনিভার্সিটি অফ লাখনৌ থেকেই পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স করার পর একই শিক্ষায়তনে পিএইচডি করার জন্য ভর্তি হন। এখানে ছয় মাস থাকাকালীন গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ এবং পদার্থবিদ্যা পড়ানোর জন্য খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি তিনি গ্র্যাজুয়েট অ্যাপ্টিচ্যুড টেস্ট ইন ইঞ্জিনিয়ারিং বা ভারতের অন্যতম প্রধান, প্রতিযোগিতামূলক এবং জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় অংশ নেন। তারপর সত্যি সত্যিই যখন ইসরোতে একটি সম্মানজনক এম. টেক. প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হলো, তখন রীতু পড়ে যান দ্বিধায়। আগে পিএইচডি শেষ করবেন না ইসরোর এম.টেক. প্রোগ্রামে যোগ দেবেন। তবে যেহেতু মহাকাশ ছিল তাঁর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার জায়গা, তাই তিনি বুঝলেন যে এই এম.টেক. প্রোগ্রামে পাস করলে ইসরোতে চাকরি পেয়ে তাঁর মহাকাশ বিষয়ক গবেষণা সংস্থায় কাজের স্বপ্ন পূরণ হবে।

‘চিরদিনই আমার বহির্পৃথিবীর রহস্য সম্পর্কে গভীর আগ্রহ ছিল এবং সেজন্যই আমি ইসরোতে যোগ দেওয়ার কথা চিন্তা করতে থাকি,’ রীতু বলেন। তাঁর পিএইচডি কোর্সের সুপারভাইজর মনীষা গুপ্তও তাঁকে ইসরোতে যোগ দিতে বলেন। তাঁর বাবা-মা ও ভাই-বোনেরাও মহাকাশের প্রতি রীতুর ভালোবাসার জন্য প্রথমবারের মতো বাইশ বছরের সেই মেয়েটিকে চিরচেনা লাখনৌ শহর ছেড়ে দূর দক্ষিণ ভারতে গিয়ে কাজ করার অনুমতি দেন। লাখনৌ থেকে দক্ষিণ ভারতে যাওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ বিমান চড়ার কথা তখন এই সাধারণ মধ্যবিত্ত মেয়েটি ভাবতেও পারেননি। দেশের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতে তাঁর লেগেছিল আড়াই দিন।

 

মৌমিতা দত্ত
১৯৯৭ সালে এম.টেক. অধ্যায়ন সমাপ্ত করার পরই রীতু ইসরোতে কাজে যোগদানের জন্য একটি ফোন কল পান। ‘সেটাই ছিল আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত- ইসরো থেকে কাজের আমন্ত্রণ পাওয়া,’ রীতু বলেন।

ইসরোতে যোগদানের পরপরই রীতু বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ পান। যদিও তাঁর প্রথম প্রকল্পের দায়িত্ব পাওয়ার মতো আরো কিছু জ্যেষ্ঠ পুরুষ কর্মকর্তা ছিলেন, তবু দায়িত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়। সংস্থার বড় বড় বিজ্ঞানীদের পাশে কাজের সুযোগ পেয়ে তাঁর আত্ম-বিশ্বাস এবং স্বপ্ন দেখার সাহস বহুগুণ বেড়ে যায়।

‘আমি যখন যোগ দিই, তখন আজকের মতো এত নারী এখানে কাজ করতো না। তবে আমাকে কখনোই আমার লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে কোনো অসমতা ভোগ করতে হয়নি। এখানে আপনার মেধাই গুরুত্বপূর্ণ, আপনার জেন্ডার পরিচয় নয়,’ তিনি বলেন।

মার্স অরবিটার মিশন-মম
জীবনে যে প্রকল্পে রীতুকে সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হয়েছে সেটা ছিল ভারতের ‘মার্স অরবিটার মিশন-মম, মঙ্গলায়ণ-১-২০১২।’ ভারতের প্রথম আন্তঃগ্রহ অভিযান প্রচেষ্টা এই ‘মঙ্গলায়ণ-১’ এর সময়সীমাও ছিল খুব কড়া আর এখানেই রীতু ডেপুটি অপারেশনস ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত হন। ‘মঙ্গলযান’ বা ভারতের মঙ্গলগ্রহ অভিযানের ক্ষেত্রে তিনি Mars Orbiter Mission (MOM) – এর ডেপুটি অপারেশনস ডিরেক্টর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। মঙ্গলযানের নকশা প্রণয়ন এবং তাকে কাজে লাগানো আর একইসাথে মঙ্গলযানের ভবিষ্যতের স্বয়ংক্রিয় উড্ডয়ন পদ্ধতি দেখভাল করার দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল।

‘মঙ্গলযান-১’ এ মহাকাশযানটির স্বয়ংক্রিয় পরিচালনা ব্যবস্থা গড়ে তোলায় রীতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন- এই স্বয়ংক্রিয় পরিচালনা ব্যবস্থাই ‘উপগ্রহের মগজ’ হিসেবে পরিচিত। রীতুর নেতৃত্বে একটি ‘সফটওয়্যার ব্যবস্থা’ গড়ে তোলা হয় এবং এ কাজে বিজ্ঞানী, বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী ও যান্ত্রিক প্রকৌশলীরা মিলে মাত্র দশ মাসে এই ‘সফটওয়্যার ব্যবস্থা’ গড়ে তোলা হয় যার মাধ্যমে মহাকাশযানটি মহাশুন্যে বিপুল দূরত্ব পার হতে পারা ছাড়াও এর সিগন্যাল গ্রহণ ও প্রেরণের যাবতীয় সমস্যা মেটানো যাবে।

‘আমাকে নিশ্চিত করতে হয়েছিল যে গোটা কাজে কোথাও এতটুকু কোন ত্রুটি বা খুঁত না থাকে। মহাকাশযান উতক্ষেপণের সময় এতটুকু ত্রুটি বিশেষত: মঙ্গল কক্ষপথ সন্নিবেশ বা অন্য আরো নানা যান্ত্রিক প্রকৌশলের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ভুল নানা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। প্রতিটি খুঁটি-নাটি বিষয় ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন,’ তিনি বলেন।

এই প্রকল্পটি পৃথিবীর সবচেয়ে সাশ্রয়ী-উপযোগী আন্তঃগ্রহ প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মঙ্গলায়ণ-১ উতক্ষিপ্ত হয়েছিল ২০১৩ সালে। পৃথিবীতে কোন দেশ সেবারই প্রথম উদ্বোধনী প্রচেষ্টাতেই মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছতে পারে। তখনি প্রথম ইসরোর কিছু নারী বিজ্ঞানীর আনন্দ উদযাপনের ছবি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে রীতু ও তাঁর কিছু কর্ম-সঙ্গীনী ভারতের ‘রকেট নারীরা’ হিসেবে পরিচিতি পান।

সত্যি বলতে ‘চন্দ্রযান-৩’ এ রেকর্ডসংখ্যক নারী বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের অংশগ্রহণ সারা বিশ্বের বিষ্ময় কুড়িয়েছে।

দুই শিশু সন্তানের মা এবং ‘মার্স অরবিটরি মিশন-মম’-এর পরিচালক হিসেবে ভূমিকা:

‘মঙ্গলায়ণ-১’ যখন ভারতের ইসরো তথা মহাকাশ বিজ্ঞানে প্রভূত সাফল্য এনে দিলো, তখন ‘বিজ্ঞানী’ সম্পর্কে সমাজে এতদিনের প্রচলিত জেন্ডার স্টিরিওটাইপ ভেঙে গেল। আর দশ জন নারী বিজ্ঞানীর মতই রীতু সে সময়কার ব্যস্ত ১৮ মাসের কথা মনে করেন। অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের তাদের পড়াশোনায় সাহায্য করার পর আবার নিজের গবেষণার কাজ নিয়ে মাঝ রাত থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত কাজ করতেন।

‘আমার বাচ্চা দুটোর প্রথমে বুঝতে সময় নিচ্ছিলো যে হুট করে কেন তাদের মা এত ব্যস্ত হয়ে পড়লো।’ যা হোক, কঠোর সময় ব্যবস্থাপনার গুণে রীতু সেই কঠিন সমুদ্রও পার হলেন। ‘পরিবার, বিয়ে, গর্ভাবস্থার সময়ে কাজ থেকে বিরতি, সন্তান-এগুলো সবই জীবনের অংশ এবং আপনার কাজ থেকে তাদের আলাদা করা যাবে না।’

রীতু বলেন, ‘আমি দৈহিকভাবে ক্লান্ত বোধ করেছি, তবে আপনি এই ক্লান্তি নানাভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেন। যখন আপনি কাজের ভালো ফল ফল দ্যাখেন, তখন সব বাড়তি পরিশ্রমের বোঝা আনন্দে পরিণত হয়,’ তিনি হাসেন।

‘মম’-এর সাফল্যের সাথে সাথেই রীতু রাতারাতি একজন ‘সেলিব্রিটি’ হয়ে ওঠেন। মহাকাশ বিষয়ক সংবাদ কেটে রাখা কিশোরী এভাবেই হয়ে উঠেছেন ভারতের অন্যতম বিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী।

‘বিভিন্ন কলেজে যখনই আমাকে বক্তৃতা দিতে ডাকা হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা এসে আমাকে ঘিরে ধরে, সাগ্রহে নানা প্রশ্ন করে এবং এ বিষয়ে ওদের এত আগ্রহ আমাকে সবসময়ই মুগ্ধ করেছে,’।

রীতু আরও বলেন, ‘আমার নিজের সন্তানেরাও স্কুলে তাদের মা এই প্রকল্পের একজন হিসেবে সবাই আলোচনা করছে দেখে খুব খুশি এবং আনন্দে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে যখন আমার ছেলে এসে আমাকে বলেছে, ‘মা, আমি তোমার জন্য খুবই গর্বিত।’

‘স্টেম’-এ ভারতীয় নারী
‘মঙ্গলযান-১’ এর সাফল্যের পর, ইসরো ২০১৯ সাল নাগাদ ‘চন্দ্রায়ণ-২‘-এর কাজ হাতে নেয়। এখানেই ইসরোর প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল চাঁদের আজও অনাবিষ্কৃত দক্ষিণ মেরুর শিলা-পাথর, খনিজ দ্রব্যাদি এবং এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি রোভার অবতরণ করানো। রীতু এই মিশনে মিশন ডিরেক্টর বা ‘অভিযান পরিচালক’ এবং এম বনিতা নামে আর এক নারী বিজ্ঞানী ‘প্রকল্প পরিচালক’ হিসেবে কাজ পরিচালনা করেছেন। এটাই কোন মহাকাশ প্রকল্প যা দুজন নারী মিলে পরিচালনা করেছেন। সত্যি বলতে, ‘চন্দ্রযান-২’ দলে নারী বিজ্ঞানীর হার ছিল ৩০ শতাংশ। যদিও এই মিশন ব্যর্থ হয়েছে, তবে তখনি প্রথম ভারতীয় নারী মহাকাশ বিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবীর নজরে আসেন।

‘চন্দ্রযান-৩’-এ রীতু প্রধান ভূমিকায় চলে আসেন। এটা ছিল ভারতের তৃতীয় চন্দ্র অভিযান এবং চাঁদের ভূ-পৃষ্ঠে ‘সফট ল্যান্ডিং’-এর দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। সারা পৃথিবী থেকে আসা শুভেচ্ছা বার্তায় ভেসে যাওয়া রীতু যেন প্রতিটি মধ্যবিত্ত ভারতীয় মেয়ের স্বপ্ন ও আকাঙ্খার প্রতীক।

রীতুর পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক মনীষা গুপ্ত ভারতের সংবাদ সংস্থা নিউজ-১৮-কে তাঁর ছাত্রী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘রীতু খুবই মেধাবী ছাত্রী ছিল। আর দশ জন পিএইচডি গবেষকের মতো সে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ছাত্র পড়ানোর কাজও করেছে।’

ইতোমধ্যেই রীতু ২০১৭ সালে ‘দ্য সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ান অ্যারোস্পেস টেকনোলজিস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ- সিয়াটি’ থেকে ‘উইমেন অ্যাচিভার্স ইন অ্যারোস্পেস অ্যাওয়ার্ড’ বা ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং নামী বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালামের হাত থেকে ‘ইসরো ইয়াং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করেছেন। নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর ২০টির বেশি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নিজের কর্মবিভায় রীতু আজ সারা পৃথিবীতেই এক আইকন এবং বিশেষত: ‘ওমেন ইন সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাথমেটিকস- স্টেম’ ক্ষেত্রে তিনি অনেক নারীর জন্যই আদর্শ। ভারতের অসংখ্য মহাকাশ অভিযানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজের নাম লেখাতে সমর্থ হয়েছেন ড. কারিধাল।

২০১৯ সালে ‘চন্দ্রযান-২’ এর মিশন ডিরেক্টর বা অভিযান পরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। সারা পৃথিবীর অসংখ্য শিশুর মতো রীতুও শৈশবে আকাশের দিকে তাকিয়ে এর অনন্ত রহস্য বোঝার চেষ্টা করতেন। তাঁর বহু বছরের অধ্যাবসায় এবং পরিশ্রম সফল হয়ে ওঠে ইসরোতে যোগদানের মাধ্যমে যেখানে তিনি পরবর্তী অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিশন বা অভিযানে কাজ করার সুযোগ পাবেন এবং অচিরেই ভারতের মহাকাশ বিষয়ক অভিযানের এক মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠবেন। ‘যে বিষয়টি আপনি ভালোবাসেন, সে বিষয়ে হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আপনি কখনোই হাল ছাড়েন না। ভুলেও কখনো জীবনের স্বপ্ন এবং আবেগের জায়গাগুলো ছাড়বেন না,’ রীতু বলেছেন গুগল ইন্ডিয়ার সাথে তাঁর এক আলাপচারিতায়।

মৌমিতা দত্ত:
‘চন্দ্রযান-৩’ এ বিজয় দাই, সৌম্যজিত চট্টোপাধ্যায়, কৃশাণু নন্দী, তুষারকান্তি দাস, অনুজ নন্দী, পীযূষ কান্তি পট্টনায়ক, কৌশিক নাগ এবং ইনসা ইরাজসহ পশ্চিম বাংলার মোট ৮ জন বিজ্ঞানী ছাড়াও একমাত্র যে বঙ্গললনা ইসরোর নারী বিজ্ঞানীদের ভেতর সম্মুখসারিতে রয়েছেন, তিনি মৌমিতা দত্ত। প্রথম দেখায় মৌমিতাকে মহাকাশ বিজ্ঞানীর বদলে একজন গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী বা মডেল বলেও ভ্রম হতে পারে। কলকাতায় বড় হওয়া মৌমিতা ২০০৪ সালে ইসরোতে যোগদানের আগে ছাত্রী জীবনে ‘চন্দ্রযান অভিযান’ সম্পর্কে পড়ে এ বিষয়ে আগ্রহী হন। নবম শ্রেণিতেই পদার্থবিদ্যায় আগ্রহী হয়ে ওঠায় প্রকৌশলী হতে সমস্যা হয়নি। বর্তমান ভারতের ‘মার্স মিশন’ বা ‘মঙ্গলগ্রহ অভিযান’-এ তিনি প্রকল্প পরিচালক। কলকাতার ‘রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ, ইউনিভার্সিটি অফ কলকাতা’ থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যায় এম, টেক, ডিগ্রি পাওয়ার পর ২০০৬-এ আহমেদাবাদে ‘স্পেস অ্যাপ্লিকেশনস সেন্টার’-এ ২০০৬ সাল নাগাদ যোগ দেন। বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্য আর সঙ্গীতও মৌমিতার ভালোবাসার জায়গা।

বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সঙ্গীতসহ নানা বিষয়ে আগ্রহী মৌমিতার বিয়ে ও মাতৃত্ব বিষয়ক কোনো তথ্য অন্তর্জালে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মিনাল রোহিত:
মৌমিতার মতোই প্রিয়দর্শিনী মিনাল রোহিত ইসরোর এক নামী বিজ্ঞানী। শৈশবে ডাক্তার হতে চাইলেও টিভিতে এক মহাকাশ বিজ্ঞান বিষয়ক শো তাঁর কর্মজীবনের লক্ষ্য বদলে দেয়। ‘মার্স অরবিটরি মিশন’ বা ‘মম’-এ তিনি ‘সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তি জীবনে মিনাল বিবাহিতা ও এক সন্তানের জননী।

নন্দিনী হরিনাথ:
২০০৩-এ ইসরোতে যোগদানের পর গত কুড়ি বছরে ১৪টি প্রকল্পে কাজ করার পাশাপাশি ‘মার্স অরবিটরি মিশন-মম’-এ তিনি ‘উপ প্রকল্প পরিচালক’ হিসেবে কাজ করেন। প্রকৌশলী বাবা ও গণিত শিক্ষক মায়ের মেয়ে টিভিতে ‘স্টার ট্রেক’ সিরিয়াল দেখে প্রথম মহাকাশ বিজ্ঞানে আগ্রহী হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিতা ও দুই কন্যার জননী।

ভারতীয় নারী বিজ্ঞানীদের ভেতর আরো আছেন বি.পি.দাক্ষায়ণী, অনুরাধা টিকে, টেসি থমাস, এন ভালারমাঠি, ভি আর ললিতাম্বিকাসহ আরও অনেকেই।
সূত্র:ইজিংবিডি

 

আইএনবি/বিভূঁইয়া