বন্ধুত্ব কি কাকে বলে, এবং কাকে বন্ধু বানাবেন

এমডি বাবুল ভূঁইয়া:

ইরানি এক কবি বলেছেন, “অসৎ বন্ধু থেকে দূরে থেকো। কেননা সে বিষাক্ত সাপ থেকেও ভয়ংকর। বিষাক্ত সাপ কেবল তোমার জীবনের ক্ষতি করবে কিন্তু খারাপ বন্ধু তোমার জীবনের সাথে সাথে তোমার ঈমানও শেষ করে দিবে।”

ইরানের বিখ্যাত মনীষী শেখ সাদী রহ.-এর এ প্রবাদ বাক্য “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।” এই বাক্যটির মূল বক্তব্য হচ্ছে, একজন ভালো বন্ধু যেমন জীবনের গতি পাল্টে দিতে পারে, তেমনি একজন খারাপ বন্ধু জীবনকে পৌঁছিয়ে দিতে পারে ধ্বংসের চূড়ান্ত সীমায়।

পবিত্র কোরআনের সূরা আন নিসার ১৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
“যারা আল্লাহর আয়াতের বিপরীতে কথা বলে, তাদের সাথে চলো না। যদি তাদের সাথে চলাফেরা করো, তাহলে তোমরাও তাদের মতো হয়ে যাবে।” শুধু তাই নয়, পবিত্র কোরআনের সুরা ফুসসিলাতের ২৫ নম্বর আয়াতে অসৎ বন্ধুকে আল্লাহর শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে সূরা মুদ্দাসসিরের ৪২ ও ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, বেহেশতবাসীরা দোজখবাসীদের জিজ্ঞাসা করবে, “তোমরা কেন দোজখের অধিবাসী হলে?” জবাবে দোজখবাসীরা কয়েকটি কারণ বলবে। তারমধ্যে একটি কারণ হিসেবে তারা বলবে, “আমরা এমন লোকদের সাথে চলাফেরা করতাম যারা ছিল অসৎ।” পবিত্র কোরআনে আরও বলা হয়েছে, “মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এমনটি করবে, আল্লাহ তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “দুনিয়াতে যার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা রয়েছে, পরকালে তার সঙ্গেই হাশর হবে।”

তিনি আরও বলেছেন, “মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। সুতরাং বন্ধু নির্বাচনের সময় খেয়াল করা উচিত সে কাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করছে?”

আমিরুল মু’মিনীন হযরত আলী রাযি. বলেছেন, “যদি ভালো লোক খারাপ লোকের সাথে উঠাবসা করে তাহলে তার মাথায়ও খারাপ চিন্তা চলে আসে।”

ইমাম জাওয়াদ এ সম্পর্কে বলেছেন, “খারাপ বন্ধুর সাথে চলাফেরা করো না। কারণ সে খোলা তলোয়ারের মত, যার বাইরের চেহারা সুন্দর কিন্তু ফলাফল খুবই বিপদজনক।”

একটা ঘটনা বলছি-
ইমাম জাফর সাদেকের এক বন্ধু ছিলো, যে সব সময় ইমামের সাথে ঘোরাফেরা করত। একদিন ইমাম বাজারে গেলেন। সঙ্গে সেই বন্ধু ও তার কাজের ছেলেটি ছিল। বাজারে ঘুরতে ঘুরতে কাজের ছেলেটি কৌতুহলবশত এটা ওটা দেখছিল এবং মাঝে মাঝে পরিচিত লোকদের সাথে কথা বলছিল। এতে সে তার মনিবের কাছ থেকে একটু পিছিয়ে পড়ল। আর এদিকে ইমাম ও তার বন্ধুটি বাজারের মাঝখানে চলে গেল। হঠাৎ পেছনের দিকে তাকিয়ে কাজের ছেলেকে না দেখে ইমামের বন্ধুর মেজাজ বিগড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি ফিরে এলে, মনিব তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। ইমামের সামনেই সে কাজের ছেলেটির বাপ-মা তুলে গালি দিল। লোকটির অশ্লীল কথাবার্তা শুনে ইমাম অবাক হয়ে তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হায় আল্লাহ! একি করলে তুমি! ছেলেটির বাপ-মা তুলে গালি দিলে? আমি তো মনে করেছিলাম তুমি একজন ধার্মিক ও খোদাভীরু লোক। এখন দেখছি সামান্য তাকওয়াও তোমার মধ্যে নেই !’

ইমাম বললেন, তুমি ছেলেটির মাকে অন্যায়ভাবে অপবাদ দিয়েছো। তাই তোমার সাথে বন্ধুত্ব রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব না। আজ থেকে তোমার সাথে আমার সম্পর্কের অবসান হলো। এ ঘটনার পর ইমাম জাফর সাদেকের সাথে ওই লোকটিকে আর কখনই দেখা যায়নি।’

আমার সল্প দৈর্ঘ্যের জীবনের ক্ষুদ্র অবিজ্ঞতা থেকে আমি বলব, কাউকে বন্ধু নামে স্বীকৃতি দেয়ার পূর্বে তার পরিবার সম্পর্কে একটু খোঁজ নিন। তার বাবা মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী না থাকুক, কিন্তু মানবিক শিক্ষার ডিগ্রীটা যেনো থাকে। নয়তো আপনি কখনোই একজন বন্ধু হিসেবে তাকে পাবেন না বরং একজন শোষক হিসেবে পাবেন। যে আপনাকে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে যাবে আর আপনি ব্যবহৃত হবেন। আমরা সবাই জানি যে ব্যবহারে বংশের পরিচয়, বাবা মায়ের মানবিকতা না থাকলে সন্তানেরর মানবিকতা আশা করা পাথরে গোলাপ ফুল ফোটানোর স্বপ্ন দেখার মতো হবে ব্যাপারটা!

বন্ধু পর্যবেক্ষন প্রথমটি হলো ‘সে আপনাকে প্রতিনিয়ত বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে সকলের সামনে হেয়/অপমানিত করার চেষ্টা করছে কিনা। হযরত আলী (রা) বলেছেন “ঠাট্টার ছলে যে তোমাকে মানুষের সামনে অপমান করে, তাকে বন্ধু বানিও না” আমি মনে করি এই লাইনটি বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই এর ভাবার্থ বিশাল। তবে এটুকু শুধু বলব বন্ধুর কাজ অপমানের হাত থেকে রক্ষা করা, অপমান করা নয়।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি পর্যবেক্ষন করতে হবে তা হলো ‘সে আপনাকে কখন স্বরণ করছে, তার খারাপ সময়ে না তার ভালো সময়ে।’ একজন প্রকৃত বন্ধু অবশ্যই নানান সমস্যার মাঝেও আপনাকে স্বরণ করবে।

তৃতীয় বিষয়টি হলো ‘ তার মনের কথা আপনাকে বলছে কি না’। যদি না বলে তাহলে কেটে পড়ুন। যে আপনাকে মনের কথা বলতে পারছে না, সে আপনার বন্ধু হতে পারবে না।

শেষ যে বিষয়টি দেখবেন তা হলো ব্যক্তিত্ব। আপনার বন্ধুর ব্যক্তিত্ব ভালো মানের হলে আপনি সার্থক এবং ভালো একজন বন্ধু পেয়েছেন।

আমাদেরও অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত। তবে বন্ধুহীন জীবন নাবিকবিহীন জাহাজের মতো। একজন প্রকৃত বন্ধুই সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার অংশীদার হয়। প্রকৃত বন্ধুই পারে আত্মার আত্মীয় হয়ে ক্ষণকালের জন্য হলেও দুঃখ-কষ্টকে ভুলিয়ে রাখতে। ‘বিশ্বস্ত বন্ধু হচ্ছে, প্রাণ রক্ষাকারী ছায়ার মতো। যে তা খুঁজে পেলো, সে একটি গুপ্তধন পেল।’

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা উচিত?
ইমাম গাযযালী রহ. এ সম্পর্কে বলেছেন, “সবাইকে বন্ধু নির্বাচন করা যাবে না, বরং ৩টি গুণ দেখে বন্ধু নির্বাচন করা উচিত।

১. বন্ধুকে হতে হবে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ।
২. বন্ধুর চরিত্র হতে হবে সুন্দর ও মাধুর্যময়।
৩. বন্ধুকে হতে হবে নেককার ও পুণ্যবান।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “শেষ বিচারের দিন সকল বন্ধুই শত্রু -তে পরিণত হবে, তবে একমাত্র সৎ বন্ধুই সেদিন প্রকৃত বন্ধু হিসেবে পরিচয় দেবে। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সততা, আমানতদারি, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্থতা প্রভৃতি গুণের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই বন্ধুত্ব যদি করতে হয়, তাহলে ইসলামের নির্দেশনা অনুসারে বন্ধু নির্বাচন করা উচিত।

আইএনবি/ বি.ভূঁইয়া