দেশের অর্থনীতিতে অশনিসংকেত

আইএনবি ডেস্ক: দেশের অর্থনীতি নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। করোনায় পর পর দুটি ধাক্কা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। দক্ষতার সঙ্গে সেটি সামলেও উঠছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এর পরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির ক্রমাগত উল্লম্ফন অর্থনীতিতে সংকট আরও ঘনীভূত করে। দেশীয় মুদ্রামানের পতন অব্যাহত রয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে আসছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্য ও শিল্পপণ্যের দাম বৃদ্ধির বিপরীতে রেমিট্যান্স প্রবাহে পতন আরেক আশঙ্কার কারণ। এরই মধ্যে অতিবন্যায় আউশের উৎপাদন কমেছে এবং খরায় আমনের উৎপাদন ব্যাহত করেছে। বন্যা যোগাযোগ অবকাঠামোকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। এ ছাড়া আগামীতে আমাদের বড় তিনটি রপ্তানির বাজারে প্রবৃদ্ধি কমার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সব কিছু মিলে আগামী ২০২৩ সালে দেশের অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত দেখছেন বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়ন সহযোগীরা।

অক্টোবর মাসের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে, আগামী বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমতে পারে। একই সঙ্গে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে ৬ শতাংশ হতে পারে। এ ছাড়া আগামী বছর মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতি নিয়ে আরও বলা হয়েছে, ‘মূল্যস্ফীতির চাপই সবচেয়ে নিকটবর্তী হুমকি, যা মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দেবে।

বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সেখানে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্ব। দিন দিন বাড়ছে মূল্যস্ফীতি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার একযোগে বাড়িয়েই চলেছে। এর জেরে বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্ব মন্দা হলে রপ্তানির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার মন্দা হলে জ্বালানি তেলের দাম হয়তো কিছু কমবে, বিশ্ববাজারে পণ্যের দরও কমবে, যা বাংলাদেশের জন্য ভালো দিক। তিনি বলেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ব্যয় কমাতে হবে। আর সুদের হার বাজারভিত্তিক করতে হবে।

সামনের দিনগুলোতে সংকটের বার্তা দিয়ে তা মোকাবিলার জন্য এখনই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ এসেছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও। খাদ্য উৎপাদন ও ঘরে ঘরে সঞ্চয় বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে তার সাম্প্রতিক সফরের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, তিনি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করেছেন; বিশেষ করে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, যেখানে সবাই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন এবং আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, ২০২৩ সালে একটি গুরুতর দুর্ভিক্ষ হতে পারে, যখন অর্থনৈতিক মন্দা আরও গভীর হবে এবং খাদ্যসংকট দেখা দেবে। সুতরাং আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং খাদ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

সরকারও ইতোমধ্যে ব্যয় সংকোচন নীতি নিয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থছাড়, গাড়ি কেনা বন্ধ এবং আপ্যায়ন, প্রশিক্ষণ, ভ্রমণসহ বিভিন্ন খাতে খরচ কমিয়ে অর্ধেক করার মাধ্যমে উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয় থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বেসরকারি খাত যাতে ব্যয় সংকোচন করে, সে জন্যও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের নীতি। বিশেষ করে জরুরি নয় এবং বিলাসপণ্যের আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে এলসি মার্জিন।

বিশ্বব্যাক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, মন্দা দরজায় চলে এসেছে। বড় বড় তিনটি অর্থনীতি ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে ইতোমধ্যে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ইউরোপে তো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিই হয়েছে। মন্দা ইতোমধ্যে চলে এসেছে তা কেমন গভীর হবে, কতটা দীর্ঘায়িত হবে এটি এখন বড় প্রশ্ন। আইএমএফসহ সবার ধারণা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা কাটছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কখন কীভাবে নিষ্পত্তি হবে তা বলা কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার ট্রাম্প আমলে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে উত্তেজনার শুরু হয়েছিল তা-ও বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এখন অনেক বেশি।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অবশ্য বিশ্বমন্দা আমাদের জন্য একটা সুখবরও নিয়ে আসতে পারে। মন্দার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে যেতে পারে। শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় কমলে বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ কমে আসবে। আবার বিপদও আসতে পারে। রপ্তানি ইতোমধ্যে কমে গেছে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে রপ্তানি আদেশ আমেরিকা থেকে না কমলেও ইউরোপ থেকে কমেছে। আগামীতে আমদানি ব্যয় কমলেও রপ্তানির ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আরেকটি সমস্যা আছে এবং তা আর্থিক খাতে। বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। বাইরের কিছু ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করতে চাইছে না। সার্বিক পরিস্থিতিতে মুদ্রাবাজার অবশ্যই ঠিক রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সমস্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে।

ড. জাহিদ বলেন, সেই সঙ্গে মূল্যম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এটি যাতে আর না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতকেও সাশ্রয়ী হওয়া দরকার। সুদহার নমনীয় হলে তাদের সাশ্রয়ী হওয়ার আগ্রহ বাড়বে। ঋণের সুদহারে ৯ শতাংশের সীমা আপাতত তুলে নেওয়া যায়। আর মূল্যস্ফীতিতে দরিদ্র মানুষের কষ্ট লাঘব করতে সামাজিক সুরক্ষা আরও শক্তিশালী করতে হবে। ফ্যামিলি কার্ডের আওতা বাড়ানো যেতে পারে। এখন ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। ৫ থেকে ৬ কোটি মানুষ জীবিকার সংকটে আছে ক্রয়ক্ষমতা কমার কারণে। তাদের সেই সংকট থেকে পুরোপুরি বের করে আনতে না পারলেও কিছু সহায়তা করা সম্ভব, যাতে তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পায়।

ড. জাহিদ হোসেনের পরামর্শ, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তায় সামনের দিনগুলোয় সর্বোচ্চ নীতিগত মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ বছর দেশীয় খাদ্য উৎপাদনে প্রকৃতি সদয় হয়নি। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, এটি ২০০৮ সালের মতো পরিস্থিতি যেন তৈরি না করে। সামগ্রিক সরবরাহ পরিস্থিতি প্রাথমিক জ্বালানি ও বিদ্যুতের প্রাপ্যতার ওপরও নির্ভর করে।

কমেছে রপ্তানি আয় : চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ ৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।

কমেছে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই-আগস্টে শিল্পের উৎপাদনের যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৪০ কোটি ডলারের, গত বছরের একই সময়ে খোলা হয়েছিল ১১৫ কোটি ডলারের ঋণপত্র। ফলে ঋণপত্র খোলা কমেছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। তবে এই সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। কমছে রিজার্ভ : আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুসারে গত ৪ অক্টোবর ৩৬ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও এ হিসাব নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। আইএমএফের হিসাবে তা সাড়ে ২৮ বিলিয়ন ডলার।

লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে রাজস্ব আহরণ : চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই ৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। আদায়ের প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না কোনোমতেই। এনবিআরের তৈরি চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসের রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সামনে আদায় বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করলেও বিদ্যমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করছেন অনেকে।
সূত্র:আমাদের সময়

আইএনবি/বিভূঁইয়া