জলবায়ুর প্রভাব স্কুলগামী শিশুদের ওপর

নূর মোহাম্মদ, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

>> ঢাকার যানজটে ৫০ ভাগ শিশু মাথাব্যথায় আক্রান্ত, ১৭ ভাগ বিভিন্ন অঙ্গে ব্যাথা

>> ৩৩ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত ঘামের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়

নবম শ্রেণির ছাত্র আহনাফ জারিফ। তার বাসা পুরান ঢাকার লালবাগে। স্থানীয় স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ভর্তি হয় মতিঝিল মডেল স্কুলে। বাসা থেকে প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে রিক্সায় চড়ে স্কুলে যায় সে। কোনদিন দেড় ঘণ্টা কখনও দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগে তার স্কুলে যেতে। আসা যাওয়ায় তার মোট তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। এ সময় রাজধানীর বায়ু, শব্দ দূষণে তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এক সময় সে স্কুলে যেতে অমনযোগী হতে থাকে। নানা স্বাস্থ্যে নানাবিধি সমস্যা দেখা শুরু করে। বাধ্য হয়ে বাবা-মা তার স্কুলে পরিবর্তন করে আজিমপুরে নিয়ে আসেন।

তার মা রোকেয়া আক্তার আইএনবিকে বলেন, প্রথম দুই মাস আমার ছেলে স্কুলে যেতে বেশ মনযোগী ছিল। রাস্তায় জ্যামজট, বায়ু, শব্দ দূষণের কারণে এক সময় সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্কুলের প্রতি অমনযোগী হতে থাকে নানাবিধি অসুখ দেখা দেয়। এরপর আমার ছেলে বলে সে ওই স্কুলে আসা যাওয়া কারণে অসুস্থ ফিল করে। পরে আজিমপুর একটি স্কুলে ভর্তি করানোর পর তার আর কোন সমস্যা হয়নি।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞতা বলছেনম প্রতিদিন ঢাকায় যে পরিমাণ শব্দ-বায়ু দূষণ হয় এর ফলে বাচ্চারা অসুস্থ হবে এটাই স্বাভাবিক। এ কারনে অনেক বাচ্চারা স্কুলে যেতে চায় না। এছাড়াও করোনা কারণৈ দীর্ঘদিন বিরতির পর স্কুল যাওয়া নিয়ে বিরক্তিভাব ছিল।

এ নিয়ে আইএনবির সঙ্গে কথা হয় একাধিক অভিভাবকদের। তারা জানান, সকাল ৭টায় স্কুলের জন্য তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে গাড়িতে বের হই। কিন্তু জ্যাম। যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগে। আড়াই ঘণ্টার ক্লাস শেষে দুপুরে বাসায় ফিরতে লাগে দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট। প্রতিদিনই এমন হচ্ছে। গাড়িতে বসে বসে বেশ কয়েকবার ঘুমাতে হয়, বাসায় ফিরেও ঘুমাই। প্রচুর ক্লান্তি আসে। পড়াশোনা করতে মন চায় না। বাসে বসে থাকতে প্রচুর ঘামে। তার শরীর দূর্বল হয়ে থাকে।

যানজট থেকে অনীহা, প্রভাব পড়ছে শিশুদের পড়াশোনায়

শিশুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের কোনো কিছুর ওপর একবার বিরক্তিভাব আসলে সেটা দীর্ঘদিন থেকে যায়। একপর্যায়ে বিষয়টির ওপর তার চরম অনীহা তৈরি হয়। একইভাবে শিক্ষার্থীরা যানজটের কারণে স্কুল যেতে বিরক্ত হচ্ছে। এর দীর্ঘমেয়াদি ফল হিসেবে একপর্যায়ে এটা তাদের পড়াশোনায় প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম আইএনবিকে বলেন, যানজটের কারণে শিশুদের দিনের শুরুটা হয় টেনশন বা স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে। তারা ভাবে, যানজটের কারণে স্কুলে যেতে দেরি হলে শাস্তি পেতে হবে। হয়তো স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এমন স্ট্রেস শিশুদের মনোজগতে প্রভাব ফেলে। মনোজগতে ভীতির সৃষ্টি করে। এ ভীতির কারণে স্কুলের প্রতি তাদের আকর্ষণ কমে যেতে পারে।

এছাড়া দীর্ঘক্ষণ যানজটে বসে থাকায় শিশুদের এনার্জি বা কর্মশক্তি হ্রাস পায়। তারা যেমন স্কুলে গিয়ে পড়াশোনার এনার্জি পায় না, বাসায় ফিরেও সেটা হারিয়ে ফেলে। সবমিলে এটা তাদের শিক্ষাজীবনে চরম ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।

যানজট শিশুর মনোজগতে যেমন প্রভাব ফেলে

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম আইএনবিকে বলেন, যানজটে বসে থাকাটা শিশুদের জন্য চরম বিরক্তিকর একটা অভিজ্ঞতা। মানুষ গতিশীল প্রাণী। মানুষ হয় হাঁটবে, না হয় ঘুমাবে। ছেলে-মেয়েরা যখন স্কুলে যেতে চাইবে তখন নির্দিষ্ট সময়ে তাকে স্কুলে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু যানজটে আটকে গেলে এটা সম্ভব হয় না। যানজট কতক্ষণে ছাড়বে, প্রতীক্ষাটা তাদের জন্য যেন মৃত্যুসমান!

তিনি বলেন, যানজটের কারণে শিশুরা যখন চরম অনিশ্চয়তায় থাকে তখন তাদের মধ্যে বিরক্তি ও ক্ষোভ তৈরি হয়। সেটা তাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত করে। একসময় তারা অল্পতেই রেগে যায়, উগ্র ও সহিংস আচরণ করে। আবেগতাড়িত হয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন কার্যকলাপ বেড়ে যায়। প্রতিদিন যানজটে পড়লে তাদের মধ্যে হতাশাও তৈরি হয়। ফলে তারা সব বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখায়।

যানজটে পড়াশোনার ক্ষতির কথা উল্লেখ করে এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, যানজটের কারণে অনেক সময় শিশুরা ক্লাস মিস করে। এতে তাদের পড়াশোনায় ঘাটতি হয়, অনেক সময় তারা সেটা পুষিয়ে নিতে পারে না। একপর্যায়ে পড়াশোনা, পরীক্ষা ও স্কুল তাদের জন্য একটা ভীতি ও আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রভাবে পড়াশোনা ও স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে শিশুরা।

শিশুদের স্নায়ুচাপ, মাথা ও শরীর ব্যথার কারণ যানজট : গবেষণা

সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে ইউনিভার্সিটি অব নর্দার্ন ফিলিপিন্স। তারা সেখানে উল্লেখ করেছে, দেশটির শিশুদের স্নায়ুচাপের প্রধান কারণ যানজট। এ কারণে তারা নির্ধারিত সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে পারে না। সেখান থেকেই চাপ শুরু। যানজটের কারণে অধিকাংশ শিশু স্কুলের প্রথম ক্লাসের পড়াশোনা ভালোমতো আয়ত্ত করতে পারে না। যা তাদের পরীক্ষার ফলে প্রভাব ফেলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-যানজটের প্রভাব নিয়ে ‘পসিবল কজেজ অ্যান্ড সলিউশন্স অব ট্র্যাফিক জ্যাম অ্যান্ড দেয়ার ইম্প্যাক্ট অন দ্যা ইকোনমি অব ঢাকা সিটি’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটের কারণে ঢাকা শহরের মানুষের ৫৫ শতাংশ সময় নষ্ট হয়। পাশাপাশি ৫০ ভাগ শিশু মাথাব্যথায় আক্রান্ত হয়। ১৭ ভাগ শিশুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা অনুভূত হয়। ৩৩ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত ঘামের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়।

শিশুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজট শিশুদের মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি শারীরিক ক্ষতিও করে। দীর্ঘক্ষণ যানজটে বসে থাকতে থাকতে শিশুদের কারও মেরুদণ্ড একটু বাঁকাও হতে পারে। আক্রান্ত হতে পারে শ্বাসতন্ত্র, স্নায়ু, মস্তিষ্ক ও কান। মানসিক চাপজনিত নানা অসুখে ভুগতে পারে তারা। এছাড়া শিশুদের স্বাভাবিক পাঠক্রমেও ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে যানজট।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থপেডিক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ও এফ জি কিবরিয়া আইএনবিকে বলেন, যানজটের কারণে শিশুদের হাড়ে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুরা যখন গাড়িতে দীর্ঘ সময় বসে থাকে তখন তাদের মেরুদণ্ডে চাপ পড়ে। ফলে পিঠ ও কোমর-ব্যথার মতো সমস্যা প্রকট হয়।

এ বিষয়ে সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক (চাইল্ড প্রটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গর্ভন্যান্স) আবদুল্লাহ আল মামুন আইএনবিকে বলেন, আমাদের শিশুদের স্কুলের সময়সীমা ও যানজটের অবস্থা বিবেচনা করা দরকার। অফিসের সময়সীমা ও স্কুলের সময় নির্ধারণের আগে শিশুদের সর্বাত্মক স্বার্থ রক্ষা হয় কি না তা ভেবে দেখা দরকার। চাকরিজীবী বা অন্যান্য শ্রেণীর নাগরিকদের সুবিধা দিতে গিয়ে শিশুদের সুবিধাগুলোতে মনোযোগ দেওয়া হয় না। তবে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শিশুর স্বার্থ দেখতে হবে।

তিনি বলেন, অধিকাংশ স্কুলে যে ধরনের অবকাঠামো থাকার কথা, তা নেই। স্কুলগুলো প্রায় বাসা বাড়ির মতোই। ফলে সবমিলিয়ে প্রতিদিন সকালে দীর্ঘ সময় যানজট পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে শিশুরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তাই স্কুলের অবকাঠামোতে পরিবর্তন আনা দরকার। এ ছাড়া, যেখানে যেখানে সম্ভব স্কুলবাসের ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ স্কুলবাস যে যানজট নিরসন করে তা না, ছেলে-মেয়েদের এক সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠে। এক সঙ্গে কাজ করা ও আলাপ আলোচনা করার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় স্কুলবাস। উন্নত সব দেশে কিন্তু স্কুলবাস শিক্ষার্থীদের নিয়ে যায়, আবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়।

এনএম/জেএস