চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যায়, পড়া বোঝে না

 করোনার প্রভাব

নূর মোহাম্মদ,জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকে

করোনার কারণে দেশের সশরীরে ক্লাস হয়নি ১৮ মাস। এ সময় অনলাইন, টেলিভিশন এবং বিকল্প পদ্ধতিতে পাঠদান করলেও তা ছিল শহরকেন্দ্রিক। গ্রাম বা চরাঞ্চলে ছিল অপ্রতুল। এরপর স্কুল খুললে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরেনি। আর যারা ফিরেছে তারা ক্লাসে আসলেও পড়া বোঝে না। এরমধ্যে মাধ্যমিকের অষ্টম-নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা কাটছেই না। এ দুই বিষয়ে অকৃতকার্য শিক্ষার্থী প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। বাংলায় অকৃতকার্যও কম নয়, ১৭ শতাংশের বেশি। প্রাইভেট পড়ায় নির্ভরতা বাড়লেও করোনা মহামারি-পরবর্তী বিদ্যালয়ে শিখন ঘাটতি কমেনি। বাড়েনি শিখন দক্ষতাও। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ শ্রেণিকক্ষে পড়া বুঝতেই পারছে না।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের এক সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

‘এডুকেশন ওয়াচ স্টাডি-২০২২-’ সমীক্ষা জরিপের বলা হয়, করোনার কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে বিদ্যালয়ে সরাসরি পাঠদান শুরু হয়। এই গবেষণাও করা হয় ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) শ্রেণিকক্ষে পাঠদান মূল্যায়ন করে। গবেষণায় অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রায় অভিন্ন দুর্বলতা উঠে এসেছে। ২০২০ সালে বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের পরের ক্লাসে ওঠানো হলেও ২০২১ সালে প্রধান তিন বিষয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল।

পোস্ট প্যানডেমিক রিকভারি অ্যান্ড রিনিউয়াল অব স্কুল এডুকেশন শীর্ষক সমীক্ষায় ৫ হাজার ৬৯২ জন শিক্ষার্থী-শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ও এনজিও কর্মকর্তা অংশ নেন। এর মধ্যে চতুর্থ, পঞ্চম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ৩ হাজার ৮২১ জন। তাদের মধ্যে অষ্টম ও নবম শ্রেণির ২ হাজার ৬৭০ জন। দেশের ৮ বিভাগের ৮ জেলা, ২৪ উপজেলা ও ৩ সিটি করপোরেশনে ৭২টি গুচ্ছে জরিপ পরিচালনা করা হয়।

একতৃতীয়াংশই ফেল
এই গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এক-তৃতীয়াংশই ইংরেজি ও গণিতে ফেল করেছে। অষ্টম শ্রেণিতে ইংরেজিতে ফেল করেছে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। গণিতে ফেল করেছে ৩৪ শতাংশ। আর বাংলায় ফেল ১৮ শতাংশ। নবম শ্রেণিতে ইংরেজিতে পাস করেনি ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। গণিতে পাস নম্বর পেতে ব্যর্থ ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ। আর বাংলায় ফেল করেছে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ।

এ দুই শ্রেণিতে প্রধান তিন বিষয়ে অকৃতকার্য সবচেয়ে কম যশোর জেলায়—৯ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে যশোরের ছয় গুণ বেশি হবিগঞ্জে—৫৭ দশমিক ১ শতাংশ। এ ছাড়া রাজশাহীতে ৪৬ দশমিক ৪, গাইবান্ধায় ২৮ দশমিক ৪, ভোলায় ২৫ দশমিক ৪, চট্টগ্রামে ২৪ দশমিক ৮, নেত্রকোনায় ১৫ দশমিক ৬ এবং ঢাকায় ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। গবেষণায় বলা হয়েছে, মাধ্যমিক স্তরে দ্রুত শিখন কার্যক্রমের ফলে অষ্টম শ্রেণির সিলেবাসের ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষা নিয়েও এক-তৃতীয়াংশ ফেল করেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার আজকের পত্রিকাকে বলেন, করোনাকালে শিখন ঘাটতি হয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর ইংরেজি ও গণিতে সাধারণত ভীতি রয়েছে। দীর্ঘদিন ক্লাস না হওয়ায় এ দুই বিষয়ে শিখন ঘাটতি আরও বেড়েছে। এ রকম যে হবে, তা আগেই ধারণা ছিল।

কমেছে শিখন দক্ষতা 
জরিপে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকেরা বলেছেন, করোনার আগে শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতা ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ (শিখন দক্ষতার মান ১ থেকে ১০ স্কেল)। তবে করোনার পর সরাসরি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চালু হলেও শিখন দক্ষতা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় শিখন ঘাটতি হয়েছে বলে মনে করেন মাধ্যমিকের ৯৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং প্রাথমিকের ৯৮ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষক। তবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত ১৯ অক্টোবর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, শিখন ঘাটতি বাড়েনি, যা ছিল তা-ই আছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ প্রাথমিকের ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ৪০ শতাংশ ছাত্র পড়া একদমই বুঝতে পারছে না। একাংশ কঠিন মনে করে। আর প্রাথমিকের ২১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ২৯ শতাংশ ছাত্রী পড়া একদমই বুঝতে পারছে না। কঠিন মনে করে একাংশ।

প্রাইভেট পড়ায় নির্ভরতা 

শিখন ঘাটতি কাটাতে অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল বলে জরিপে উঠে এসেছে। শহর এলাকায় এই নির্ভরতার হার ৯১ দশমিক ৪ শতাংশ। গ্রামে ৮৮ শতাংশ। শহরের উপকণ্ঠে ৮৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ঢাকা মহানগরে ৭৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ঘাটতি কাটাতে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেটের পেছনে ব্যয় বেড়েছে। ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে এই ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৯৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

শিখন ঘাটতির কারণ 
শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির জন্য জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষকদের ৯০ দশমিক ৯৫ শতাংশই দায় দিয়েছেন পরিবারের দায়িত্বহীনতাকে। পরিবার ও শিক্ষার্থীর মনোযোগ না থাকার কথা বলেছেন ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষক। শিখন ঘাটতির অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্লাস করলেও পড়া বুঝতে না পারা, শিক্ষকদের কম সময় দেওয়া ইত্যাদি। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ব্যাপারে অভিভাবকদের আরও সম্পৃক্ত হতে বলেছেন।

এদিকে অভিভাবকেরা শিখন ঘাটতি কাটাতে শিক্ষক নিয়োগ এবং আরও শিক্ষকের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর তাগিদও দিয়েছেন তাঁরা।

শিখন ঘাটতি মোকাবিলায় গবেষণায় বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা, পড়াশোনাকে আনন্দদায়ক করা, দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি।

করোনার সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বেশ কয়েক মাস অনলাইনে ক্লাস হয়। শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এসব ক্লাস করে। গবেষণা বলছে, এসব ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। অভিভাবকেরা মনে করেন, ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কম্পিউটারে এবং ৭৪ শতাংশ মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ৮৬ শতাংশ অভিভাবক বলছেন, ১ থেকে ২ ঘণ্টা ডিজিটাল ডিভাইসে সময় ব্যয় করছে শিক্ষার্থীরা।

শিখন ঘাটতির বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান বলেন, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়া চলমান।

একই বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, করোনার দুই থেকে আড়াই বছরে শিখন ঘাটতি হয়েছে, এটি সত্য। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এনএম/এজেসএস