ব্যাংকিং খাতের সমস্যা আরো গভীরে চলে যাচ্ছে: সিপিডি

আইএনবি ডেস্ক: বহু বছর ধরেই ব্যাংকিং সেক্টর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা বা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই অবস্থা হয়নি। সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে এই খাত ক্রমাগতভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে বক্তারা ব্যাংকিং খাতের নানা সংকট তুলে ধরেন। এ সময় তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা করেন।

গতকাল শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘সংকটে অর্থনীতি, কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, এমপি। আলোচনায় অংশ নেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রমুখ। সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

নব্বইয়ের দশকে ব্যাংকিং খাত সংস্কারে গঠিত কমিশনে নিজের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ঐ সময়ে যে সমস্যাগুলো শনাক্ত করা হয়েছিল, এখনো সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এখন সমস্যা আরো গভীরে চলে গেছে। আমরা লাইফ টাইম এটা নিয়ে কথা বলে যাচ্ছি। জীবদ্ধশায় এর সমাধান হবে কি না জানি না। অথচ আইন প্রণেতা সংসদ সদস্যরা এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন না। সঠিক জায়গায় তারা তুলে ধরছেন না।

সংলাপে বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে সমালোচনার জবাবে পরিকল্পামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বলা হচ্ছে, কে চালাচ্ছে অর্থনীতি। দেশের অর্থনীতি অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, গভর্নর কেউ চালাচ্ছে না। দেশের অর্থনীতি ‘বাই রুল’ ‘বাই অর্ডার’ ‘বাই অবলিগেশন’ চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, এটাই আইন। তিনিই দেশের প্রধান, তার থেকেই সবকিছু নিচের দিকে নেমে আসে। আজ যদি আমি অসুস্থ থাকি দেশের অর্থনীতি তো থেমে থাকবে না। আমরা অর্থনীতি চালাচ্ছি, জেনেশুনেই চালাচ্ছি। নিত্য আমরা আপডেট করার চেষ্টা করছি। গ্রামে যখন যাই তখন গ্রামীণ মানুষ চায় বিশুদ্ধ পানি, একটা ভাতার কার্ড, স্কুল ঘর এসব। অর্থনীতির এসব তারা বুঝে না।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান অর্থমন্ত্রীর নীরবতার বিভিন্ন বক্তব্যে বিষয়ে বলেন, লোটাস ফুল বছরে কিছু সময় ফুটে থাকে, আর বাকি সময় ঘুমিয়ে থাকে। আমরাও আশায় আছি কখন আবার ফুটে উঠার সময় আসবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার বলছে জানুয়ারিতে ডলার সংকট কেটে যাবে, কিন্তু আমি মনে করি এই সংকট আরো ছয় মাস থাকতে পারে। সরকারি হিসাবে ৩৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বলা হচ্ছে, কিন্তু এটা প্রকৃত হিসাবে ২৬ বিলিয়ন ডলার। যদি নিট হিসাব করি সেটা আরো কমে যাবে। বিভিন্ন ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে তিনি বলেন, পর্যবেক্ষক দিয়ে কি হবে, তারা শুধু দেখবে। ঋণের অনিয়ম নিয়ে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়নি, কখনো বন্ধ হয়নি এসব বলা হচ্ছে। কিছু ব্যাংককে বন্ধ হতে দিতে হবে, যাতে করে উদাহরণ হয়ে থাকে। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো থেকে টাকা সরিয়ে অন্য ব্যাংকে রাখা হচ্ছে এমন উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, গত মাসের হিসাবে ৩৬ শতাংশ আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে শুধু ব্র্যাক ব্যাংকে। এটা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। এতেই বুঝা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ টাকা অন্য ব্যাংকে রাখছে।

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সুশাসনের অভাবেই ব্যাংকে এই দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক পরিচালক করার সুযোগ বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান অবস্থা কোভিড বা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে হটাত্ করে আসেনি। এখন এক বছর পর মনিটরিং পলিসি করা হচ্ছে। এটা তো বাজেট নয়, বছরে দুই বার মনিটরিং পলিসি করা যেতেই পারে। তিনি বলেন, অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এখানে ভুল নীতি প্রণীত হচ্ছে। হোটেলে বসে মুদ্রানীতির প্রধান চলকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অদ্ভুত! আগে কোনো দিন এ রকম ঘটনা শুনিনি। মার্কিন ডলারের চার রকমের দর নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) মাফ করে দেওয়ার ঘটনাও এখন ব্যাংক খাতে দেখা যাচ্ছে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার বাড়তি খরচ মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাড়তি টাকা ধার করছে। অর্থমন্ত্রী যদি টাকা ছাপিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায় সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। যে মুদ্রানীতির কথা আমরা শুনেছিলাম, তাতে সংকোচনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তথ্য-উপাত্তে তা আর দেখা যায়নি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও এত টাকা লুট করেনি যা এখন ব্যাংক থেকে লুট করা হয়েছে। শেয়ারবাজারে ধস কয়েক বার হয়েছে, এক বারও বিচার হয়নি। টাকা পাচারের একটা চক্র তৈরি হয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে আমলারা জড়িত, রাজনীতিবিদরা জড়িত এবং একটা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী জড়িত বলে তিনি মনে করেন। এজন্য শোভনীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১০ বছর ব্যবসা করলে যে আয় করা সম্ভব তার চেয়ে বেশি সম্ভব এক বছরে ব্যাংক লুটের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, চাটার দল রয়েছে, এই চাটার দল এখনো রয়েছে তারা আস্ত ব্যাংক গিলে খাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা একটা অর্থনৈতিক যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি কিন্তু আমরা অর্থমন্ত্রীকে কোথাও দেখছি না। অথচ তার নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মাওলানা ভাষানী রাজনৈতিক সমস্যা শুরু হলে হাসপাতালে চলে যেতেন। আমাদের অর্থমন্ত্রীও সেটা অনুসরণ করছেন কি না আমরা জানি না। অর্থ মন্ত্রণালয় একচ্ছত্র নীতিতে চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে আমরা আরো সংকটে পড়ব। আমরা শুনেছি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জন জয়েন্ট সেক্রেটারি নাকি গভর্নর থেকেও বেশি শক্তিশালী ছিল। তিনি রাজনীতিবিদদের মতো আচরণ করতেন। ব্যাংক ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আস্থা ফিরিয়ে আনতে ব্যাংক কমিশন করা প্রয়োজন। কীভাবে লুটের টাকা ফেরত আসবে সেই উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশে অনেকের বাড়ি রয়েছে। তাদের তালিকা করে করের আওতায় এনে কীভাবে বৈধতা দেওয়া যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। মূল উপস্থাপনায় ফাহমিদা খাতুন উল্লেখ করেন, সরকারি হিসাবের চেয়েও দেশে মূল্যস্ফীতি বেশি। রাজধানী ঢাকায় চার সদস্যের একটি পরিবারের খাবারের পেছনে প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা। আর খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিয়ে ছোট করলে ব্যয় দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা। কিন্তু নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের যে আয় তা দিয়ে খাদ্যপণ্য কিনে টিকে থাকা কঠিন। আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বাড়ছে, তার চেয়েও বেশি হারে বাড়ছে স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম। বিশেষ করে চাল, আটা, চিনি, ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে সেই প্রভাব নেই।

অভ্যন্তরীণভাবে উত্পাদিত পণ্যের দামও কারণ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী। এ ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, খেলাপি ঋণ এখন কত, তা সবার মুখস্থ। এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যাংকগুলোতে মূলধনের ঘাটতি থেকেই যাবে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ যা দেখানো হয়, বাস্তবে তা আরো বেশি। অর্থনীতিবিদেরা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) এ কথা বলে থাকে। ইত্তেফাক

আইএনবি/বিভূঁইয়া