জটিলতা কমেছে ভূমি ব্যবস্থাপনায়

এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা

আসাদুজ্জামান আজম

তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে পাল্টে গেছে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান। বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছেছে। প্রযুক্তির বদৌলতে প্রতিটি ঘরে ঘরে এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া। মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে হাতের মুঠোয় বিশ্ব। বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংকটে যখন গোটা বিশ্ব বিচ্ছিন্ন, মানুষে মানুষে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়েছিল ইন্টারনেট। ডিজিটাল প্রযুক্তি কল্যাণে দেশের জনগণ করোনা মহামারিতেও সংযুক্ত থাকতে পেরেছে। ঘরে বসেই সরকারি সেবা পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রযুক্তির সুবিধা থেকে পিছিয়ে নেই ভূমি খাত।

প্রযুক্তির বদৌলতে জটিল ভূমি ব্যবস্থাপনায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। দীর্ঘসূত্রতা নিরসনের পাশাপাশি কমেছে হয়রানি। নিশ্চিত হয়েছে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা।

ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, বর্তমান সরকারের সময়ে অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে গত তিন বছরে বেশ কিছু ঈষর্ণীয় সাফল্য এসেছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের গৃহীত নীতি, কৌশল ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে দেশের অবকাঠামোগত পরিবর্তন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচনসহ জনমানুষের জীবনমান ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ভূমিসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

এটুআইয়ের সহায়তায় ই-মিউটেশন, অনলাইনে আরএস খতিয়ান, মুসলিম আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর, মৌজা ম্যাপ অনলাইনে প্রকাশ অন্যতম। ‘হাতের মুঠোয় ভূমিসেবা’ স্লোগান সামনে রেখে ভূমিসেবার সকল ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিক ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের মর্যাদাপূর্ণ ‘ইউনাইটেড নেশনস পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ পেয়েছে বাংলাদেশ ভূমি মন্ত্রণালয়। দেশব্যাপী ই-মিউটেশন উদ্যোগ বাস্তবায়নের স্বীকৃতি হিসেবে এ পুরস্কার পেয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সারা দেশের মোট ৪৯ হাজার ৪৮১টি মৌজার আরএস স্বত্বলিপি চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং তা ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবপোর্টালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। দেশের মোট ৫১০টি উপজেলা ও সার্কেল ভূমি অফিসে ই-নামজারি চালু হয়েছে। ই-নামজারি চালু করায় সরকার গৌরবজনক ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ এবং ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমিসেবা ডিজিটাইজেশনের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার-২০২০’ অর্জন করেছে।

তথ্য মতে, ২০১৯ সালে ১ জুলাই সারা দেশে একযোগে শতভাগ ই-নামজারি বাস্তবায়ন শুরু হয় (তিনটি পার্বত্য জেলা বাদে)। বর্তমানে ৪৮৫টি উপজেলা ভূমি অফিস ও সার্কেল অফিসে এবং তিন হাজার ৬১৭টি ইউনিয়ন ভূমি অফিস ই-নামজারি বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে গত বছরের ১৭ মার্চ হতে ম্যানুয়াল আবেদন গ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। প্রান্তিক অঞ্চলে অনেক সময় সেবাগ্রহীতারা ভূমি অফিসে সেবা নিতে গিয়ে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। এখন ই-মিউটেশনের কারণে তারা বাসায় বসেই করতে পারেন। অর্থাৎ ভূমি অফিসে ই-নামজারি চালু হওয়ায় দালালদের দৌরাত্ম্য ও মাঠ পর্যায়ে দুর্নীতির সুযোগ কমছে, সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি এবং সর্বোপরি সেবা পেতে কম সময় ও কম খরচ হচ্ছে। মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, সরকারি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে নেয়া হয়েছে উদ্যোগ। ভূমি ডাটা ব্যাংকের মাধ্যমে শতভাগ খাসজমি চিহ্নিতকরণ, ছবিসহ খাসজমি, অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি, সায়রাত মহালের শক্তিশালী ডাটাবেজ তৈরির মাধ্যমে জনগণের জন্য তথ্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। যার কারণে অনলাইন সফটওয়্যার ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে খাসজমি বন্দোবস্ত, জলমহাল, বালুমহাল ও হাটবাজার ইজারা নেয়া যাবে। ভূমি সেবা দ্রুত সময়ে শেষ করতে সারা দেশে এক হাজার ৬৩৯টি ভূমি অফিস স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।

দেশে সকল খতিয়ানের তথ্য একটি প্লাটফর্মে আনার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ে সকল আরএস খতিয়ানসমূহ একটি সিস্টেমের মাধ্যমে জনগণের কাছে অবমুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে যেকোনো নাগরিক মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে অথবা অনলাইনের মাধ্যমে তারা কাঙ্ক্ষিত খতিয়ান এবং খতিয়ানের জন্য আবেদন করতে পারে। এই প্লাটফর্মে প্রায় চার কোটি ৪৩ লাখ খতিয়ান অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে যার মধ্যে— সিএস খতিয়ান ৯০,২১,৪০৬টি; এসএ খতিয়ান ১,২০,৮২,৭৮১টি; আরএস খতিয়ান প্রায় দুই কোটি ছয় লাখটি এবং দিয়ারা খতিয়ান ১৩,২৫,৫৩৬টি।

ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের মাধ্যমে ১৭ ধরনের ভূমিসেবা অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার তথা ই-মিউটেশন, রিভিউ ও আপিল মামলা ব্যবস্থাপনা, অনলাইন ভূমি উন্নয়নকর, রেন্ট সার্টিফিকেট মামলা ব্যবস্থাপনা, মিউটেটেড খতিয়ান, ডিজিটাল ল্যান্ড রেকর্ড, মৌজা ম্যাপ ডেলিভারি সিস্টেম, মিস মামলা ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও অকৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা, দেওয়ানি মামলা তথ্য ব্যবস্থাপনা, হাটবাজার ব্যবস্থাপনা, জলমহাল ব্যবস্থাপনা, বালুমহাল ব্যবস্থাপনা, চা-বাগান ব্যবস্থাপনা, ভিপি সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, ভূমি অধিগ্রহণ ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ বাজেট ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ‘ল্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ সিস্টেম সফটওয়্যারের মাধ্যমে একই কাঠামোয় আনার উদ্যোগে নেয়া হয়েছে। এরপর আন্তঃপরিচালনযোগ্য ডাটাবেজ তৈরি করে সরকারের অন্যান্য সব সেবার সাথে সমন্বয় করা হবে। দেশব্যাপী এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে ভূমি মন্ত্রণালয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য নেয়া হয়েছে প্রকল্প। এ প্রকল্পে স্যাটেলাইট ও ড্রোনের মাধ্যমে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে, নির্ভুলভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য সারা দেশের ৪৭০টি উপজেলার মৌজা পর্যায়ে জিওডেটিক সার্ভের মাধ্যমে ২,৬০,৩১০টি জিও-রেফারেন্সিং পয়েন্ট নির্ধারণ এবং ১,৩৩,১৮৮টি মৌজা ম্যাপের ডাটাবেজ ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হবে। হাতের মুঠোয় ভূমিসেবা দেয়ার লক্ষ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে বলে ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

কৃষিজমির পরিমাণ মোট জমির ৮৪ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন আবাসন, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য কৃষিজমি ব্যবহারের ফলে কৃষিজমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। এমতাবস্থায় কৃষিজমি সুরক্ষা এবং নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে উদ্যোগ। মৌজা ও প্লটভিত্তিক জাতীয় ডিজিটাল ভূমি জোনিং প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ অনুযায়ী ভূমিকে প্লটওয়ারী কৃষি, আবাসন, বাণিজ্যিক, পর্যটন ও শিল্প উন্নয়ন ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে মৌজা ও প্লটভিত্তিক ডিজিটাল ভূমি জোনিং ম্যাপ ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের কৃষি জমি সুরক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জিত হবে বলে মনে করছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।

ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ভূমিসেবা জনগণের দোরগোড়ায় নিতে পৌঁছে দিতে আমরা কাজ করছি। একজন সাধারণ মানুষ ঘরে বসেই দ্রুত সময়ে সেবা পেতে পারেন— সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। এ জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়কে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক মন্ত্রণালয় গঠন করে দেশের মানুষকে ভূমিসেবা দেয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম— মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছর পর আমার মনে হচ্ছে আমরা সেই দিকেই অগ্রসর হচ্ছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ভূমি মন্ত্রণালয় ঠিক পথেই এগোচ্ছে।