স্কুল নয়, ওদের ঠিকানা শুঁটকি পল্লী

আসাদুজ্জামান আজম, কক্সবাজার থেকে ফিরে :

পারিবারিক প্রচুর অভাব অনটন এবং হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ার কারণে ১৩ বছর বয়সী কায়সার এবং তাঁর বড় ভাইকে শুঁটকি পল্লীর শ্রমিক হতে হয়েছিল। প্রাইমারীর গন্ডি না পেরুতেই দুই ভাই এখন দু;বেলা খাবার জোগার করতে শিশু শ্রমিক। এই হঠাৎ সৃষ্ট দুর্ভাগ্যের জন্য সে এবং  ১৫ বছর বয়সি বড় ভাই ইমরান, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। শারীরিক নানা সমস্যা নিয়ে নাজিরাটেক শুঁটকি পল্লীতে প্রায় তিন বছর ধরে ওরা কাজ করছে।

কায়সার জানান, আগে সূর্যের নীচে আমাকে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করার কারণে তাদের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যার সম্মূখীন হতে হত। তবে বর্তমানে সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রচার প্রচারণামূলক কর্মকান্ডের কারণে অনেকটা ভালো আছে।

উপকূলীয় জেলা – কক্সবাজার, খুলনা এবং সাতক্ষীরা- অঞ্চলে প্রায় ৫০ টি শুঁটকি পল্লী রয়েছে যেখানে এক লক্ষেরও বেশি মানুষ সরাসরি এই খাতে জড়িত।

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের ‘নাজিরার টেক’ বা ‘নাজিরার টেক শুঁটকি পল্লী তে প্রায় ৫০০ পরিবারের বসবাস এবং কম-বেশী সব পরিবারই এই শুঁটকি তৈরীর সাথে জড়িত। এই শুঁটকি ব্যবসার শুরু ১৯৮৭ সালে এবং স্থানীয়ভাবে এটি ‘চ্যাং’ নামে পরিচিত। নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লীর অধিকাংশ মানুষ জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় নিম্নবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। দেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম শুঁটকি উৎপাদনকারী পল্লী। প্রায় ২,৮০০ শিশু কেবল কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লীতে কাজ করছে।

 

নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লী ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আতিকুল্লাহ সাওদাগর বলেছেন, প্রায় ৩০,০০০ শ্রমিক নাজিরাটেক শুঁটকি পল্লীর ১,০৪০ টি শুঁটকি মাছ প্রসেসিং ইউনিটে কাজ করেন এবং তাদের বেশিরভাগই দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন।

সিভিক এনগেইজমেন্ট এন্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং বিশেষজ্ঞ মোঃ তানভীর শরীফ বার্তা  সংস্থা আইএনবি;কে বলেন, বিভিন্ন শ্রম নিবিড়খাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির অনেক সাফল্য স্বত্বেও শুঁটকি পল্লী খাতে শিশুশ্রম নিয়ে আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত।

 

তিনি বলেন, এই সেক্টরে কর্মরত শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক ও লবণাক্ত জলের সংস্পর্শে আসে এবং প্রতিকূল কাজের পরিস্থিতিতে কাজ করে। প্রতিদিন তাঁরা কোনও প্রতিরক্ষামূলক কিছু ছাড়াই বিপজ্জনক পরিবেশে নয়ঘন্টারও বেশি সময়ধরে কাজ করে। এরুপ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার কারণে তাঁরা  ত্বকের রোগ এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যায়পড়ে। আরও বড় কথা হলো, এসকল শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি থাকে না বললেই চলে।

বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণার কারণে শুঁটকি ক্ষেত্রে শিশুশ্রমের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

 

তানভীর শরীফ জানিনান, শুঁটকি খাতের শিশুশ্রমকে বিপজ্জনক কাজ হিসাবে বিবেচনা করার খসড়া তৈরি করা হয়েছে এবং শিগগিরই এটি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করা হবে।

 

ব্যবসায়ীরা জানান বর্তমানে খোলার মালিকগণ শিশু শ্রমের ব্যাপারে খুব সজাগ।  সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে মার্কিন ভিত্তিক উইনরক ইন্টারন্যাশনালের আওতাধীন এনজিও, বাংলাদেশ শিশু শ্রম উন্নয়ন (ক্লাইম্ভ) প্রকল্প বিভিন্ন প্রচারণামূলক কর্মকান্ডের জন্য শিশুশ্রম কমে আসছে।

 

বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রামস (বিসিসিপি) ক্লাইম্ভ  প্রকল্পের অধীনে এক সমীক্ষা অনুসারে, কক্সবাজার সদর ও মহেশখালী উপজেলার ছয়টিশুঁটকি পল্লীতে প্রায় ২,৯০০ শিশু কাজ করছে। শুঁটকি পল্লীগুলো হলো ঠাকুরতলা, ঘোটিভাঙ্গা, খুরুশকুল, চৌফোল্ডোন্ডি, সোনাদিয়া এবং নাজিরারটেক। এই শুঁটকি পল্লী গুলোতে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু শ্রমিক।