আড়াই লাখ মার্কিন ডলার রপ্তানি করতে চায় বাংলাদেশ

নূর মোহাম্মদ, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

>> সমুদ্র বিজয়কে কাজে লাগতে নানা তৎপরতা বাংলাদেশের
>> জাতিসংঘের মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত বণ্টন চায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমির মাধ্যমে। তবে এই অর্জনের পথে গত ৮ বছরে বাংলাদেশ নিজেদের প্রস্তুতি কিছুটা সম্পন্ন করলেও বাস্তবায়নে অগ্রগতি খানিকটা কম। কারণ, ব্লু-ইকোনমির অন্যতম শর্ত হচ্ছে উচ্চমানের দক্ষতা ও কারিগরি অভিজ্ঞতা।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুসারে, বিশ্বের প্রতিবছর ৮ কোটি ৪৪ লাখ টন সামুদ্রিক খাবার আহরণ করা হয়। বিশ্বের মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’- তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র ৭ লাখ টন মাছ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের ইন্সটিটিউট-এর অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী আইএনবিকে বলেন, ‘এখনো সমুদ্র থেকে আমরা মূলত মাছ এবং চিংড়ি বেশি ধরা হয়। কারণ খাবার হিসাবে বাংলাদেশিদের ভেতরে এগুলোর চাহিদাই বেশি রয়েছে। তবে ইদানীং অনেক জায়গায় অক্টোপাস, স্কুইড, ক্যাটলফিস, কাঁকড়া বা ঝিনুক খাওয়ার চল তৈরি হয়েছে।’’

বিদেশে রপ্তানির অপার সম্ভবনা

অক্টোপাস, ক্যাটলফিস,কাঁকড়া, বা স্কুইডের স্থানীয় বাজারে চাহিদা কম থাকলেও এগুলোও প্রচুর পরিমাণে ধরা হয়। কারণ এসব মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আগের অভিজ্ঞতা ও টেকনিক্যাল প্রস্তুতির সক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে এ সম্পর্কে অভিজ্ঞ দেশগুলোর সহায়তা নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমির।

কক্সবাজারের একজন ট্রলার মালিক জয়নাল আবেদীন আইএনবিকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের মাছ বেশি ধরি। ইলিশ মৌসুমে যেমন ইলিশ বেশি ধরা হয়। এছাড়া সাগরের অন্যসব মাছও আমরা ধরি। কিছু মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়ে যায়, কিছু আবার শুঁটকি হয়, রপ্তানি হয়।’ তিনি জানান, ‘বাংলাদেশের জেলেরা দক্ষিণে মিয়ানমারের সীমানা আর পশ্চিমে ভারতের সীমানা পর্যন্ত গিয়ে মাছ ধরে ‘

বাংলাদেশ যে অঞ্চলের মালিকানা পেয়েছে, সেখানে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করা সম্ভব।  এই ক্ষেত্র চারটি হলো তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন।

ব্লু ইকোনমি নিয়ে বাংলাদেশের তৎপরতা

বাংলাদেশে সমুদ্র বিজয় নিয়ে যে মাতামাতি হয়েছিল, তারপর সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে যে গতিতে এগোনো উচিত ছিল, বাস্তব পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে ব্লু ইকোনমি সেল’ নামে একটি ক্ষুদ্র প্রশাসনিক সেল গঠন ছাড়া তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। কিন্তু এই সেলের হাতে কোনো আইনগত ক্ষমতা নেই। তাদের সিদ্ধান্ত মানার ক্ষেত্রেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এসব বিবেচনায় সংসদীয় কমিটি ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে সেলের বদলে আইনগত ক্ষমতা দিয়ে একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছিল।

এরপর প্রায় তিন বছর কেটে গেছে, কোনো ফল মেলেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৪ ও ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে দুটি ওয়ার্কশপ করে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাব্য ২৬টি খাত চিহ্নিত করেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশিদ আলম আইএনবিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পন্ন হয়েছে। সাগরে বাংলাদেশের সমান একটা জলসীমা আমরা পেয়েছি। এখন একে কাজে লাগিয়ে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

গত জুনে জাতিসংঘে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের জন্য আয়োজিত সমুদ্রতলের সম্পদে টেকসই উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রাপ্ত সুবিধার ন্যায়সঙ্গত বণ্টন ও স্বল্পোন্নত, ভূবেষ্টিত স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপ-রাষ্ট্রসমূহের সুযোগ’ শীর্ষক এক ব্রিফিং অনুষ্ঠানে এই সহযোগিতা চান  জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা।

কি আছে আমাদের বঙ্গোপসাগরে?

মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় নতুন সমুদ্রসীমা অর্জনের দুই বছর পর ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমানার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এরপর থেকে কখনো ধীরে কখনো দ্রুতগতিতে ব্লু-ইকোনমি চূড়ান্ত রূপরেখার কাজ করতে থাকে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের মালিকানায় রয়েছে বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিশাল এ জলসীমাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

বাংলাদেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ বিদ্যমান তার সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, এই সম্পদের প্রায় সমপরিমাণ (৮১ শতাংশ) সম্পদ সমুদ্র তলদেশে আছে।

বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ও জৈব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আছে। ২০১৭-১৮ সালে দেশে উৎপাদিত মোট ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার মাছের মধ্যে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টনই এসেছে সমুদ্র থেকে।

এদিকে ‘সেভ আওয়ার সি’ র দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে ০.৭০ মিলিয়ন টন মাছ বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা আহরণ করে। নানা প্রজাতির মূল্যবান মাছ ছাড়াও সমুদ্রসীমায় নানা ধরনের প্রবাল, গুল্মজাতীয় প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির চিংড়ি, তিন প্রজাতির লবস্টার, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়।

গবেষণা নতুন নতুন উদ্যোগ

নতুন সমুদ্রসীমা অর্জনের পরের বছরই ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা  করে বাংলাদেশ। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ১২তম মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী দক্ষ পেশাজীবী তৈরি হচ্ছে, যারা ব্লু-ইকোনমি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারবেন।

এদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সদর দপ্তরের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিচার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিমরাড) নামে একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এটি ২০১৮ সালে সাবেক নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সমুদ্রসম্পদের টেকসই ব্যবহারের জন্য সামুদ্রিক বুদ্ধিজীবী, গবেষক এবং প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত করে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ ব্ল ইকোনমির ভবিষৎ কি জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর রিয়াল এডমিরাল মুহাম্মদ মুসা আইএনবিকে বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদেসীমা জয়ের পর বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমি অপার সম্ভবনা তৈরি হয়েছে। এখনো সমুদ্র থেকে আমরা মূলত মাছ এবং চিংড়ি বেশি ধরা হয়। কারণ খাবার হিসাবে বাংলাদেশিদের ভেতরে এগুলোর চাহিদাই বেশি রয়েছে। তবে ইদানীং অনেক জায়গায় অক্টোপাস, স্কুইড, ক্যাটলফিস, কাঁকড়া বা ঝিনুক খাওয়ার চল তৈরি হয়েছে।’ অক্টোপাস, ক্যাটলফিস,কাঁকড়া, বা স্কুইডের স্থানীয় বাজারে চাহিদা কম থাকলেও এগুলোও প্রচুর পরিমাণে ধরা হয়। কারণ এসব মাছ বিদেশে রপ্তানি হয় ‘

শৈবাল, শামুক ঝিনুক

মাছের বাইরেও বঙ্গোপসাগরের কিছু উদ্ভিদ এবং শামুক-ঝিনুকের চাহিদা রয়েছে দেশে ও বিদেশে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে শামুক, ঝিনুকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়া বিদেশেও এটা রপ্তানি হয়। ফলে বাংলাদেশে এটি প্রচলিত একটি খাবার না হলেও সমুদ্র থেকে এটাও আহরণ করা হয়।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। ২০২৫ সালে এ খাত থেকে এক’শ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে দেশটির সরকার।

এ ছাড়াও চীন, জাপান, ফিলিপাইনসহ বেশ কিছু দেশ দুই থেকে তিন’শ বছর আগেই সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছে। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে।

এদিকে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনাসমূহ পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ।

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের বিশাল জলসীমাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের যে অঞ্চলের মালিকানা পেয়েছে, সেখানে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করা সম্ভব।

এই ক্ষেত্র চারটি হলো তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন। বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ও জৈব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে দেশে উৎপাদিত মোট ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন এসেছে বঙ্গোপসাগর থেকে। অথচ এ সমুদ্র এলাকায় বছরে ৮০ লাখ টন মাছ ধরার সুযোগ রয়ে গেছে।

এদিকে ‘সেভ আওয়ার সি’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে ০.৭০ মিলিয়ন টন মাছ বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা আহরণ করে। নানা প্রজাতির মূল্যবান মাছ ছাড়াও সমুদ্রসীমায় নানা ধরনের প্রবাল, গুল্মজাতীয় প্রাণী, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, তিন প্রজাতির লবস্টার, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়। উপকূলীয় অঞ্চলের ৫ লক্ষাধিক জেলের জীবন-জীবিকার জোগান আসে এই সমুদ্র থেকেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রাণিসম্পদ ছাড়াও ১৩টি জায়গায় আছে মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম। এগুলোতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইটের মতো মূল্যবান ধাতব উপাদান।

এনএম/জেডএইচ