ঝুঁকিতে চাঁদপুর শহররক্ষা বাঁধ, শঙ্কার স্থানীয়রা

আসাদুজ্জামান আজম

দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ পন্থায় বালু উত্তোলন এবং বর্ষায় পানি বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট ঢেউ ও স্র্রোতে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধ। বাঁধটির পুরান বাজার, নতুন বাজার, বড় স্টেশন অংশের দ্রুত সংস্কারে উদ্যোগী হতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। না হলে আসন্ন বর্ষায় চাঁদপুর সদর উপজেলার একটি বড় অংশ ভাঙনের কবলে পড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, ২০১৯ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো ৪৫০ কোটি টাকার একটি স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরে সেটি কাটছাঁট করে চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ পুনর্বাসন প্রকল্প নামে তিন হাজার কোটি টাকার স্থায়ী একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই চলছে। ডাকাতিয়া ও মেঘনা নদীর মোহনা, নতুন বাজার অংশের মোলহেড এলাকায় এলাকায় কাজ চলছে। চাঁদপুর শহরকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে স্থায়ী সমাধান খুঁজছে মন্ত্রণালয়।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম এমপি আইএনবিকে বলেন, ‘চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ পুনর্বাসন প্রকল্পটির সমীক্ষা চলছে। প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হবে। চলতি বর্ষায় যাতে বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্যও পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
চাঁদপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্র মতে, পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় চাঁদপুর শহর। এরমধ্যে ডাকাতিয়া নদী শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। শহরের পাশে এক সময় ১৮ কিলোমিটার চওড়া ছিল মেঘনা নদী। এখন তা সংকুচিত হয়ে দেড় কিলোমিটারে চলে এসেছে। শহরের নতুন বাজার এবং পুরান বাজার বড় স্টেশন এলাকায় তীব্র স্রোতের কারণে ব্লকবাঁধ দেবে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাঁধ। কয়েক দফা জিও ব্যাগ ফেলে ঝুঁকি কিছুটা কমিয়ে এনেছে চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড।

জানতে চাইলে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘পানি উন্নয়নের বোর্ডের চাহিদার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। বাঁধের কিছু অংশ সংস্কার প্রয়োজন। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।’

স্থানীয় পাউবো অফিস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে শহরের নতুন বাজার অংশে বড় স্টেশন মাদ্রাসা রোড থেকে মোলহেডের পুরোনো লঞ্চঘাট পর্যন্ত ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি। প্রতিদিন একটু একটু করে এই এলাকার ব্লক সরে যাচ্ছে। সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন ও রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের বাকি অংশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

২০১৯ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, আইডব্লিউএম, সিজিআইএসসহ বিভিন্ন দপ্তরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটি একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন দেয়। এরপর তিন হাজার কোটি টাকা চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ পুনর্বাসন প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হয়। মন্ত্রণালয়ে যাচাই কমিটি বিস্তারিত সমীক্ষার কাজ চলছে।

জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র মতে, চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনা নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে শত শত ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙনের শিকার হচ্ছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। বালু উত্তোলন সিন্ডিকেটের মূলহোতা স্থানীয় লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সেলিম খান। অনুমতি ছাড়াই ওই চেয়ারম্যান বছরের পর বছর বালু বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দীর্ঘদিন বালু ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।

বালু উত্তোলনের কারণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও নদীভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশসম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধসহ আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়ন হুমকির মুখে রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদপুর শহরসহ আশপাশের বসতি রক্ষা উদ্যোগী হয় জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন সূত্র মতে, সেলিম খান ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসনের কাছে ডুবোচর কাটার অনুমতি চান। জেলা প্রশাসন সেই অনুমতি না দিলে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করেন। জনস্বার্থে ডুবোচর কেটে নৌপথ সচল করার কথা বলে রিটটি করা হয়েছিল। সেলিম খানের রিটের উপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালে মেঘনার ডুবোচর থেকে ৩০ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

বালু উত্তোলনের অনুমতি থাকলেও বালু বিক্রি করার কোনো অনুমতি নেই। তিনি যা করেছেন তা সম্পূর্ণ অবৈধ। এই বালু উত্তোলন থেকে সরকারের রাজস্ব খাতে এক টাকাও জমা হয়নি। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে ভাঙনকবলিত মানুষ, জেলে ও জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।

ওই চিঠির পর গত ২১ মার্চ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এক সভায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর নদীর রক্ষা কমিশন একটি সিদ্ধান্ত জারি করার পর প্রায় ৩০০ নৌযান, বাল্কহেড ও ড্রেজার গুটিয়ে পালিয়ে গেছে।

গত ৩১ মার্চের পৃথক আরেক সভায় চাঁদপুরে মেঘনা নদী থেকে যারা অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ঈদের পর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বছরের পর বছর যারা অবৈধভাবে বালু তুলেছেন, তার একটা হিসাব তৈরি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। ওই সভায় চাঁদপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশের সভাপতিত্বে সভায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার ৭২ কর্মকর্তা অংশ নেন।

অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলায় চাঁদপুরের জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে বালু তোলা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে চাঁদপুর শহরও ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে বলে জানান বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, চাঁদপুরে পদ্মা ও মেঘনার ডুবোচর থেকে ড্রেজার দিয়ে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে দেদার বালু তোলার পেছনে একজন মন্ত্রীর ছত্রছায়ার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় প্রশাসনকে তোয়াক্কা না করে ওই মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে বালু উত্তোলন করে আসছিলেন তারা। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়ার কথা জানিয়ে ওই মন্ত্রীর ১৪টি ডিও লেটারের তথ্য পেয়েছে কমিশন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডুবোচর খননের জন্য আদালত তাকে নির্দিষ্ট একটি মৌজায় বালু উত্তোলনের আদেশ দিলেও তা বিক্রির অনুমতি দেননি। তবু এত বছর ধরে বালু বিক্রি করছেন। এ ছাড়া কাউকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিলেও কিছু বিধিনিষেধ থাকে। এ ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে বেড়েছে নদীভাঙন। সরকারে বিভিন্ন দপ্তর সক্রিয় হয়ে উঠলে বালু উত্তোলনের সরকারি রয়্যালটি, ভ্যাট ও আয়কর বাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ১৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা জমা দেয়ার আবেদন করেছেন সেলিম খান।

জেলা প্রশাসন বালু উত্তোলন বন্ধে কঠোর উদ্যোগ নেয়ার মধ্যেই গত ২২ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসকের কাছে টাকা জমাদানের আবেদন করেন তিনি। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএর কাছে আরও চার কোটি ৫৭ লাখ টাকা জমা দেয়ার আবেদন করেছেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন বিষয়ে জবাব চেয়ে সেলিম খানকে পাল্টা চিঠি দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

তাতে উল্লেখ করা হয়েছে— ৭৫৪৫/২০১৫ রিট পিটিশনের ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিলের আদেশে হাইকোর্ট আপনাকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিলেও বিক্রির অনুমতি দিয়েছেন কি-না তা উল্লেখ করেননি। আদালত কিংবা ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএসহ কোনো সরকারি সংস্থা বালু বিক্রির অনুমতি না দিলেও কীভাবে সরকারি বালু বিক্রি করে অসাধুভাবে লাভবান হচ্ছেন, তার উত্তর জানা প্রয়োজন।

নদী রক্ষা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, উচ্চ আদালতের আদেশের কথা বলে তারা বালু উত্তোলন করছে। আদালতের আদেশ মেনে যদি তারা বালু উত্তোলন করত তাহলে এমনটি হতো না। আদালত তাদের কয়েকটি নির্দিষ্ট মৌজায় ড্রেজিংয়ের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু সেই মৌজাগুলো কোথায় তার কোনো ম্যাপ তাদের কাছে নেই। তাছাড়া আদালত তাদের বালু বিক্রির আদেশ দেননি।

অথচ তারা বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে। বন্ধ বালু উত্তোলন, গা ঢাকা দিয়েছে সেলিম খান, খুঁজছে দুদক : অবশেষে গত ৪ এপ্রিল ইউপি চেয়ারম্যান মো. সেলিম খানকে মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলনে অনুমতি দিতে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। আগামী ২৫ এপ্রিল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে বালু উত্তোলনের অনুমতি বাতিলের বিষয়ে শুনানি হবে। আদালতের স্থগিত আদেশে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

এদিকে, বালু খেকো চেয়ারম্যান সেলিম খানের ‘অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। তার দাখিলকৃত সম্পদের হিসাবও অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

দুদক সূত্র জানায়, চেয়ারম্যান সেলিম খানের নামে সম্পদ, স্ত্রী-সন্তান ও তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের মালিকানাধীন নৌযানের সংখ্যা ও মূল্য, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের রেকর্ডপত্র, পদ্ম-মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সেলিম খানকে অনুমতি দেয়া হয়েছে কি-না সে সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র তলব করা হয়েছে। আদালত, সরকারি দপ্তর ও দুদকের চাপের মুখে গা-ঢাকা দিয়েছেন চেয়ারম্যান সেলিম খান। গত ১৫ দিনে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। মন্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।