কাজ তুলতে পারেনি পাউবো

বিশ্বব্যাংকের শিথিল শর্তেও

মোহাম্মাদ সাদ্দাম হোসেন: ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চল। সম্প্রতি অব্যাহত বৃষ্টিপাত ও উজানের পানির ঢলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে দেশের ১৩টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। বছর জুড়ে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, নদীভাঙন, অনাবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যার মতো দুর্যোগ লেগেই থাকে। এ অবস্থায় ২০১৬ সালে ৫ বছরমেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৪০ উপজেলায় বন্যার পূর্বাভাসসহ বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্র স্থাপনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রকল্পের গতি না থাকায় বিশ্বব্যাংক ক্রয় প্রক্রিয়ার শর্ত শিথিল করে। তাতেও প্রকল্পের মেয়াদ শেষে বরাদ্দের মাত্র ২৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ক্রমাগত উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি। কিন্তু বন্যাসহ অন্যান্য দুর্যোগের পূর্বাভাস জানা গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যেত। কারণ দুর্যোগের সঠিক সময়ে পূর্বাভাস পেলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে এনে নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৪০টি উপজেলার জন্য নেওয়া এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার থেকে ২২ কোটি টাকা ব্যয় হবে। বাকি ৩১৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেবে বিশ্বব্যাংক।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ুর অভিঘাত সম্পর্কে যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট সেক্টর ও কমিউনিটিকে অবহিত করতে বিশ্বব্যাংক সহায়তায় ‘বাংলাদেশ ওয়েদার অ্যান্ড ক্লাইমেট সার্ভিস রিজিওনাল প্রকল্প (বিডব্লিউসিএসআরপি)’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। তিনটি ধাপে এ প্রকল্পটি পাউবো বাস্তবায়ন করছে। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন নাগাদ এর কাজ শেষ হওয়ার কথা। অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদ পার হয়ে গেলেও বরাদ্দের মাত্র ২৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। তবে ভৌত অগ্রগতি একটু বেশি ৪৩ শতাংশ। এখন নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।

প্রকল্পের আওতায় দেশব্যাপী ৩০৮টি ম্যানুয়াল পানি সমতল পরিমাপক স্টেশনে টেলিমিটারিং যন্ত্রপাতি স্থাপন, ২৫৭টি বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্রের অটোমেশন, পাউবো কর্র্তৃক পরিচালিত ৩টি আবহাওয়া স্টেশন আধুনিকায়ন, ভূগর্ভস্থ পানি সমতল স্টেশন অটোমেশন ৯০৫টি, বিভিন্ন প্রকার হাইড্রোলজিক্যাল যন্ত্রপাতি ক্রয়, উপকূলীয় ৪০টি জলোচ্ছ্বাস স্টেশন স্থাপন, হাইড্রোলজিক্যাল যন্ত্রপাতিসমূহের পরিচালন, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ আধুনিকায়ন, পাউবোর আইসিটি সিস্টেম আপগ্রেডেশন, পরামর্শক নিয়োগ; কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাউবোর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে হাইড্রোলজিক্যাল মনিটরিং নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন এবং বিভিন্ন আধুনিক হাইড্রোলজিক্যাল যন্ত্রপাতি ক্রয় করে দেশের বন্যার পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নয়নসহ নদীবাহিত বন্যা, আকস্মিক বন্যা, বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা এবং সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের বিষয়ে আগাম সতর্কবার্তা প্রদান ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে। এছাড়া পানি সম্পর্কিত অন্যান্য দুর্যোগ যেমন নদীভাঙন, লবণাক্ততা, পলি প্রবাহ, খরার পূর্বাভাস বা আগাম সতর্কবার্তা প্রদান ব্যবস্থার উন্নয়ন, হাইড্রোলজিক্যাল যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।

কিন্তু কাক্সিক্ষত হারে প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জীভূত বাস্তব অগ্রগতি ৪৩ শতাংশ ও আর্থিক অগ্রগতি ৮৮ কোটি ৬ লাখ টাকা, যা মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ২৫.৮৫ শতাংশ।

প্রকল্পের ক্রয় প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের কাজে গতি আনতে তাদের ক্রয়সংক্রান্ত শর্ত শিথিল করে। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী ৬৩টি প্যাকেজের পরিবর্তে বর্তমানে ৫৫টি প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে পণ্যের প্যাকেজ ২৩টির পরিবর্তে ২০টি ও পরামর্শ সেবার প্যাকেজ ২২টির পরিবর্তে ১৭টি করা হয়েছে। পূর্ত কাজের ৫টি প্যাকেজের মধ্যে সব দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত দুটি প্যাকেজের কাজ সমাপ্ত হয়েছে ও তিনটির কাজ চলমান রয়েছে। পণ্যসংক্রান্ত ২০টি প্যাকেজের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৯টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে এবং ১৩টি প্যাকেজের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। অবশিষ্ট ৬টি প্যাকেজের কাজ বর্তমানে চলমান রয়েছে। পাশাপাশি নন-কনসালটেন্সি সার্ভিস ১৩টি প্যাকেজের মধ্যে ১০টি প্যাকেজের কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে; যার মধ্যে সমাপ্ত ৪টি ও চলমান ৬টি। পরামর্শক সেবা কাজের মোট ১৭টি প্যাকেজের মধ্যে ১৩টির কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রকল্পের আওতায় মাঠপর্যায়ে ইতিমধ্যে স্থাপিত বিএম পিলার, ভূগর্ভস্থ পরিমাপক স্টেশন ও রেইন গেজ পরিদর্শন করা হয়। স্থাপিত ৩০৮টি বিএম পিলারের মধ্যে ৭০টি বিএম পিলার পরিদর্শন করে দেখা যায় ৬৮টি পিলার ভালো আছে এবং যথাযথভাবে স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২টি বিএম পিলারের ক্ষেত্রে সামান্য ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে। ৮টি ইকো-সন্ডার, ১টি সাইড স্ক্যান সোনার, ১২টি জিপিএস, ১টি সার্ভে বোর্ড, ৬টি টোটাল স্টেশন পর্যবেক্ষণ করে ভালো অবস্থায় পাওয়া গেছে।

প্রকল্পের তদারকির বিষয়ে কাজ করে সরকারের সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এ প্রকল্পে তদারকি করেও বেশ কিছু সমস্যা পেয়েছে সংস্থাটি। এ প্রসঙ্গে আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রকল্পের তদারকি করে বেশ কিছু সমস্যা পাওয়া গেছে। এগুলো বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে জানানো হয়েছে। আশা করি এই প্রতিবেদনের পর প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়বে এবং সমস্যা সমাধান হবে।