প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতা নয় ; ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি

মোহাম্মাদ সাদ্দাম হোসেন: ষড় ঋতুর বাংলাদেশের চির চেনা প্রকৃতির রূপ বদলে গেছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে তীব্র খরায় পুড়ে দেশ। বর্ষা মৌসুমে অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাতের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়। আবার শীত মৌসুমে তীব্র শৈতপ্রবাহ বয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝর ও জলাবদ্ধতার প্রকোপ ক্রমাগত বাড়ছে। যার প্রভাবে কৃষি, শিল্পসহ দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৫ এপ্রিল সাত বছরের মধ্যে দেশের তাপমাত্রার সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সেদিন দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে। সেদিন যশোরে ৪১ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয়েছে। আর ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের বেশিরভাগ এলাকায় ওই দিন ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপমাত্রা ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বেকর্ডকৃত আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ওই দিন রাজশাহীতে তাপমাত্রা ছিল ৪৫ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর ১৭ বছর পর ১৯৯৫ সালের ২৫ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোরে। ওই দিন  যশোরের তাপমাত্রা ছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল ফের যশোরেই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। একই বছর চুয়াডাঙার তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও রাজধানীতে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের পর দেশের দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উঠেনি। রাজধানীর তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক পাঁচ এর নিচে ছিল। সাধারণত ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রাকে মাঝারি, ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয় এবং ৪০ ডিগ্রির বেশি হলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার ঢাকার তামপাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি, যশোরে ৩৫ দশমিক ছয় ডিগ্রি ও বরিশালে ৩৪ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ একেএম নাজমুল হক আজকালের খবরকে বলেন, বাংলাদেশে মার্চ, এপ্রিল ও মে-এই তিন মাস সব চেয়ে শুষ্ক থাকে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এপ্রিলে বৃষ্টি শুরু হয়। কিন্তু বিগত ৬৩ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।
এই আবহাওয়াবিদ আরো বলেন, ৩২ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রায় ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবারে ধান হিটশকের কবলে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে সাধারণত মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এপ্রিল মাস থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এ বছর জুলাই মাসের অর্ধেক সময় চলে গেলেও কাঙ্খিত বৃষ্টিপাত হয়নি। দেশের নদী, খাল, বিলের পানি কমে গেছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় তীব্র খরায় পুড়ছে রবি ফসলের ক্ষেত। মাত্রাতিরিক্ত তাপদাহের কারণে বাদাম, মরিচ, মুগডালসহ হাজার হাজার হেক্টর রবি ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আম, লিচুসহ বিভিন্ন গাছের ফল শুকিয়ে ফলন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সব মিলিয়ে কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কৃষির পাশাপাশি শিল্পসহ নানা কাজে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় হু হু করে বঙ্গোপসাগরের লবনাক্ত পানি প্রবেশ করছে। লবণ পানির কারণে বরিশালে কলেরা ও ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) আবহাওয়াদি ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক আজকালের খবরকে বলেন, দেশের ওপর দিয়ে উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার কারণে গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চলতি বছর। ১৯৪৮ সালের পর সবচেয়ে বেশি খরা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির কারণে সাগর থেকে জোয়ারের লোনা পানি মিঠাপানির প্রবাহে প্রবেশ করেছে। লবণ পানিতে কলেরার জীবাণু থাকে। খরার কারণে কৃষিজমিসহ সর্বত্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি গবেষণা হওয়া দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত উষ্ণতা ও দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) তথ্যানুযায়ী, প্রায় বছরই ভারতের পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় চার হাজার বর্গকিলোমিটার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এক হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ফসল ছাড়াও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে। সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, নীলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আকস্মিক বন্যার কারণে বোরো ধান পরিপক্ব হওয়ার আগেই কাটতে হয়। অনক সময়ে পানিতে তলিয়ে যায়। আবার খরার কারণে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কত কয়েক বছর ধরে খরার কারণে আউশ ও বোরো ধান, পাট, ডাল ও তেল ফসল, আলু, শীতকালীন সবজি এবং আখ চাষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। মার্চ-এপ্রিলের তীব্র খরায় বোনা আমন, আউশ এবং পাট চাষ যথাসময়ে করতে পারছে না কৃষকরা। আগস্ট মাসের অপরিমিত বৃষ্টি রোপা আমন চাষ বাধাগ্রস্ত করে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে আবার কম বৃষ্টিপাতের কারণে বোনা ও রোপা আমন ধানের উৎপাদন কমছে। ডাল ও আলু চাষ দেরিতে শুরু করতে হয়। কাঁঠাল, লিচু, কলা ইত্যাদি ফলের গাছ অতিরিক্ত খরায় মরে যায়। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে নদী-নালার নাব্য হ্রাস এবং গাছের প্রস্বেদনের হার বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহের ফলে আমের মুকুল নষ্ট হয় ও নারিকেলের ফলধারণ ব্যাহত হয়। বঙ্গোপসাগরে পানির স্তর বাড়ায় মিঠাপানির প্রবাহে লবন পানি প্রবেশ করছে।
এআইএস’র তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৩ সনে ১৫ লাখ হেক্টর জমি মৃদু লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়, যা ১৯৯৭ সনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ হেক্টেরে। বর্তমানে এর পরিমাণ প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর। উজান থেকে পানিপ্রবাহ বাধা ও কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশের মোট উপকূলীয় এলাকা প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর, যার মধ্যে বর্তমানে প্রায় ১০.৫০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (ডুয়েট) জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন কেন্দ্রীয় গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. মো. আকরামুল আলম আজকালের খবরকে বলেন, উন্নত বিশ্বের শিল্পায়িত দেশগুলোর অতিমাত্রায় কার্বন নির্গমনের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃতি বৈরি আচরণ করছে। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে অনেক প্রাণী পরিবেশের সঙ্গে টিকে থাকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের কৃষি-অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।