রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য সিলেট

এস এম শাহনূর
১৯১৩ সালে বাংলা ভাষায় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিস্ময়কর প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ।কবির ভাষায় ‘আমাদের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনায় নজরুল’। ‘মমতাবিহীন কালস্রোতে বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে নির্বাসিতা তুমি সুন্দরী শ্রীভূমি। ভারতী আপন পুণ্যহাতে বাঙালীর হৃদয়ের সাথে বাণীমাল্য দিয়া বাঁধে তব হিয়া। সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।’ [রবীন্দ্রনাথের সিলেট ভ্রমণের স্মারক গ্রন্থ, ১৯৪১ সালে প্রকাশিত, ‘কবি প্রণাম’-এ সিলেট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লিখিত এবং ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ স্বাক্ষরিত, কিন্তু তারিখবিহীন উপরোক্ত কবিতাটি পাওয়া যায়। রবীন্দ্র গবেষকদের অনুমান ১৯৩৬ সালে এই কবিতা রচিত হয়েছিল।বর্তমানে কবিতাটির মূল কপি আছে বিড়লা সংগ্রহে।অন্য তথ্য থেকে জানা যায় কবিতাটি লেখা হয়েছিল নগেন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাড়িতে।]৫ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শৈলশিখরে অনুপম সাদা মেঘের খেলা করা শিলং এ এসেছিলেন। নোবেলবিজয়ী বিশ্বকবির শিলং এ আসার বার্তা সিলেটে আসা মাত্রই তৎকালীন শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক গোবিন্দ নারায়ণ সিংহ কবিকে শ্রীহট্টে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি টেলিগ্রাম পাঠালেন। প্রতিউত্তরে কবি অপারগতা প্রকাশ করে Journey Long and tedious লিখে ‘তার বার্তা’ পাঠালেন। কবির অসম্মতিসূচক বার্তা পেয়ে ‘আঞ্জুমান ইসলাম, শ্রীহট্ট মহিলা সমিতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শ্রীহট্টে কবিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠালেন। সিলেট এম সি কলেজের এক শিক্ষকের পাঠানো তারবার্তা ছিল, ‘Sylhet desires India’s greatest son to honour her by his visit’. (ভারতের বরপুত্র শ্রীহট্ট ভ্রমণ করে তাকে গৌরবান্বিত করুন)। অগত্যা কবি শ্রীহট্ট ভ্রমণের সম্মতি জানালেন। (বাংলা বর্ষপঞ্জিকা তথ্যমতে ১৩২৬ বঙ্গাব্দ)।১৯১৯ সালের ৪ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ সিলেটের উদ্দেশ্যে আসেন এবং কুলাউড়া স্টেশনে রাত যাপন করে ৫ নভেম্বর বাংলা ১৩২৬ সনের কার্তিক। না শীত না গরম। চমৎকার আবহাওয়া। সিলেট এলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।সিলেটে তিনি ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করেন । তখন শিলং থেকে সড়কপথে সিলেট আসার ব্যবস্থা ছিল না।শিলং তখন আসামের রাজধানী এবং শ্রীহট্ট আসামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর/প্রদেশ। চেরাপুঞ্জি দিয়ে দুর্গম পথে থাবায়/ খাসিয়াদের পিঠে চড়ে আসতে হতো। এ কথা শুনে কবি বলেছিলেন ‘বরং দশ মাইল হেঁটে পাহাড় উৎরাই করতে পারি তবু মানুষের কাঁধে চড়তে পারব না।’ তাই আসাম-বেঙ্গল রেলপথে গুয়াহাটি-লামডিং-বদরপুর-করিমগঞ্জ-কুলাউড়া দিয়েই সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলেন। কবির সফরসঙ্গী ছিলেন-তাঁর পুত্র শ্রীযুক্ত রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পুত্রবধূ শ্রীযুক্তা প্রতিমা দেবী। কবিকে অভ্যর্থনা জানাতে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের একটি অগ্রবর্তী দল- বদরপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কুলাউড়া এসে কবি রাতযাপন করেন ট্রেনে। মাইজগাঁও বরমচাল, ফেঞ্চুগঞ্জ প্রভৃতি স্টেশনেও কবিকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল।
➤সফরসূচি ৫ নভেম্বর ১৯১৯ ইংরেজী: ৫ নভেম্বর ১৯১৯। ১৩ কার্তিক ১৩২৬ বুধবার। হেমন্তের সকালে কবি ‘শ্রীহট্ট বাজার’ রেলস্টেশন পৌঁছান। কবিকে অভ্যর্থনা জানান মিউনিসিপ্যালটির তৎকালীন চেয়ারম্যান রায় বাহাদুর সুখময় চৌধুরী, আবদুল করিম সাহেব, সাবেক মন্ত্রী খান বাহাদুর আবদুল মজিদ, রায় বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্তসহ শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আতশবাজি, তুমুল হর্ষধ্বনি হাজার জনতার উল্লাসে মুখরিত ছিল শ্রীহট্ট কবির পদার্পণে সঙ্গে সঙ্গেই। তখন সুরমা নদীর ওপর ‘কিনব্রিজ’ ব্রিজ ছিল না। সুরমা ঘাটে ছিল সুসজ্জিত মারবোট ও বজরা। কবি বোটে চড়ে নদী পার হলেন। নদীর উভয় তীরে বিশাল জনসমুদ্র কবিকে এক নজর দেখতে ছিল উন্মুখ। বন্দে মাতরম, রবীন্দ্রনাথ কী জয় ইত্যাদি ধ্বনিতে মুখরিত ছিল চারদিক। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে হাজার জনতার আনন্দ উল্লাসে প্রকম্পিত ছিল সিলেট নগরী। মৌলবী আবদুল্লা সাহেবের স্বেচ্ছাসেবক দল, মজুমদারবাড়ি, দস্তিদারবাড়ি, আহিয়া সাহেবের বাড়ির প্রতিনিধিসহ হাজারো জনতা কবিকে নদীরপাড়ে চাঁদনীঘাটে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।ওই সময় চাঁদনি ঘাটকেও সুসজ্জিত করা হয়েছিল। মঙ্গলঘটসহ তারকা,পত্র-পুষ্প সম্ভারে লালসালু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল ঘাটের প্রতিটি সিঁড়ি। চাঁদনিঘাটে কবি ঘোড়ায় টানা পুষ্পসজ্জিত ফিটন গাড়িতে ওঠেন। গাড়িতে তাঁর পাশে বসেন সিলেটের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মৌলভি আবদুল করিম। তিনি কবির পূর্বপরিচিত ছিলেন।(তাঁর লেখা ‘Islam’s Contribution in Science and Civilization’ বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।) প্রায় দশ হাজার লোকের সোয়া মাইল দীর্ঘ মিছিল কবিকে এগিয়ে নিয়ে এসেছিল। শহরের (নয়া সড়কে) একটি টিলার ওপর ছিল প্রেসবাইটেরিয়ান পাদ্রি টমাস সাহেবের বাংলো।তার অস্তিত্ব আজ নেই। বর্তমানে সেখানে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং একটি বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে।কবি সিলেট সফরকালীন সময়ে সেখানেই বাস করেছিলেন। সেখানে পৌঁছালে কবিকে সংগীত ও চন্দন তিলকের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হয়। ০৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে আয়োজিত উপাসনায় কবিগুরু তাঁর নিজের রচিত ব্রাহ্ম সংগীত গেয়ে শোনান ‘বীণা বাজাও হে মম অন্তরে’। “বীণা বাজাও হে মম অন্তরে/ সজনে বিজনে বন্ধু, সুখে দুখে বিপদে/ আনন্দিত তান শুনাও হে মম অন্তরে” এই গানটি গেয়েছিলেন/ উপনিষদের মন্ত্র উচ্চারণ করে উপাসনা শুরু করেছিলেন। ইন্দু দেবী গাইলেন- ‘মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দর বেশে এসেছো তোমায় করি গো নমস্কার।’ ব্রাহ্ম মন্দিরে উপাসনা শেষে কবি চলে যান তার জন্য নির্ধারিত পাদ্রীর বাংলোয় এবং রাত যাপন করেন।
➤সফরসূচি ৬ নভেম্বর ১৯১৯ ইংরেজী: ০৬ নভেম্বর সকালে স্থানীয় লোকনাথ হল, পরে যেটা সারদা হল নামে পরিচিত হয়েছিল সেখানে হাজারো জনতার উপস্থিতিতে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। উকিল অম্বিকা চরন দে রচিত উদ্বোধনী সংগীত গাইলেন যতীন্দ্র মোহন দেব চৌধুরী। সংগীতটি ছিলো এ রকম :
মাতৃভাষার দৈন্য নেহারি কাঁদিল তোমার প্রাণ/ হৃদয় কমলে শ্রেষ্ঠ আসন বাণীরে করিলে দান। পুরিল বঙ্গ নবীন আনন্দে/ উঠিল বঙ্গ পুলকে শিহরি শুনিয়া নবীন তান। এ নহে দামামা, নহে রনেভেরী, এ যে বাঁশরীর গান। সে সুধা লহরী মরমে পশিয়া আকুল করিল প্রাণ। সপ্ত সাগর সে সুরে ছাইল, চমকি জগৎ সে গান শুনিল।/ বিশ্ব কবির উচ্চ আসন তোমারে করিলে দান। হেথায় ফুটেনা শ্বেত শতদল, ফুটেনা হেথায় রক্ত কমল, বনফুল দুটি করিয়া চয়ন এনেছি দিতে উপহার। এ দীন ভূমির ভক্তি অর্ঘ্য চরণে লভুক স্থান।’ আঞ্জুমানে ইসলামিয়া সিলেট জেলার সভাপতি খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ (কাপ্তান মিয়া,আসাম প্রাদেশিক পরিষদের শিক্ষামন্ত্রী) এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা সভায় মানপত্র পাঠ করেছিলেন নগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত। সভাপতি কবির পরিচয়(উর্দু ভাষায়)৪ তুলে ধরার পর রতনমনি টাউন হলে কবিগুরু ‘বাঙালির সাধনা’ সম্বন্ধে প্রায় দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা করেছিলেন। কবির সেই ভাষণটি অনুলিখন করেন উপেন্দ্র নারায়ণ সিংহ ও মনোরঞ্জন চৌধুরী। যা পরে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ‘বাঙালির সাধনা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।কবি তাঁর বক্তৃতায় বলেন- ‘তাই বলছি, আজ এই সভাতে আপনাদের সঙ্গে আমার এই যে যোগ হলো সে কেবল সাহিত্যের যশ নিয়ে নয়। এর ভিতরে একটি গূঢ় কথা আছে যা খ্যাতির চেয়ে অনেক বড়। সে কথাটি এই যে বাংলাদেশের লোক আপনার মধ্যে একটি শক্তির জাগরণ অনুভব করছে ’। ‘বাঙ্গালীর সাধনা’ শীর্ষক দেড় ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতাটি পরে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘Towards the future’ নাম দিয়ে মডার্ণ রিভিয়ু পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তার বক্তৃতায় দেশপ্রেম অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার দিক-নির্দেশনা প্রতিফলিত হয়। অনুষ্ঠান শেষে মুরারি চাঁদ কলেজের বাংলা ও সংস্কৃতির অধ্যাপক নলিনী মোহন শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে তাঁর বাসভবনে কিছু সময়ের (মধ্যাহ্নভোজে) আতিথ্য গ্রহণ করেন। দুপুর দুইটার দিকে ‘শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি’ আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় যোগ দিতে দ্বিতীয়বার বন্দরবাজারস্থ ব্রাহ্ম মন্দিরে যান কবি।অভিনন্দন পত্র পাঠ করেন নলিনীবালা দেবী। রূপার পাত্রে মানপত্র দেয়া হয়। পাদ্রি টমাস সাহেবের বাংলোয় বহির্দ্বারে টাঙানো ছিল মণিপুরীদের তৈরি প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো একটি আচ্ছাদন বস্ত্র। ওই আচ্ছাদন বস্ত্রে মণিপুরী শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় পেয়ে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই প্রবল আগ্রহ নিয়ে—-৬ নভেম্বর বিকালে শহরের একপ্রান্তে মাছিমপুর মণিপুরী পল্লীতে কবি গিয়েছিলেন। সেদিন মাছিমপুরের মণিপুরীদের পরিবেশিত মণিপুরী নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন বিশ্বকবি।সেখানে মণিপুরী সম্প্রদায় কবিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। কবি মণিপুরী মেয়েদের তাঁতে বোনা কাপড়, তাদের শিল্প নৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হন। মণিপুরী ছেলেদের রাখাল নৃত্য দেখে কবি বিমোহিত হলেন। পরবর্তীতে মণিপুরী মেয়েদের ‘গোষ্ঠলীলা’ নৃত্য দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য বিভাগ চালু করেন। তিনি ”কমলগঞ্জের মণিপুরী গ্রাম বালিগাঁওয়ের নৃত্যগুরু নীলেশ্বর মুখার্জীকে নিয়ে যান শান্তিনিকেতনে। এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পায় মণিপুরী নৃত্য। খ্যাতি লাভ করে বিশ্বনন্দিত নৃত্য হিসাবে।”৩ চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা, মায়ার খেলা, নটীর পূজা, শাপমোচন নৃত্যনাট্যে মণিপুরি নৃত্যের স্থান দেন। বলা হয়ে থাকে মণিপুরি নৃত্য কে মণ্ডপ প্রাঙ্গন থেকে বের বিশ্বমণ্ডলে স্থান করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
➤সফরসূচি ৭ নভেম্বর ১৯১৯ ইংরেজী: ০৭ নভেম্বর সকালে কবি নগরীর চৌহাট্টা এলাকার এতিহ্যবাহী সিংহ বাড়িতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।গোবিন্দ নারায়ণ সিংহ মহাশয়ের বাড়িতে নবজাতকের নামকরণ অনুষ্ঠানে একটি প্রার্থনা সভায় যোগ দেন। ওইদিন কবি মুরারীচাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) হোস্টেলে সংবর্ধিত হন এবং হাজারো ছাত্র জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা দান করেন। বক্তৃতার সারমর্ম ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ‘আকাঙ্ক্ষা’ নামে শান্তিনিকেতন পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। উত্তরকালে এটি ‘আকাঙ্ক্ষা’ নামে পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এমসি কলেজের বক্তৃতায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “কোন পাথেয় নিয়ে তোমরা এসেচ? মহৎ আকাক্ষা। তোমারা বিদ্যালয়ে শিখবে বলে ভর্ত্তি হয়েচ। কি শিখতে হবে ভেবে দেখ। পাখী তার বাপ মায়ের কাছে কি শেখে? পাখা মেলতে শেখে, উড়তে শেখে। মানুষকেও তার অন্তরের পাখা মেলতে শিখতে হবে, তাকে শিখতে হবে কি করে বড় করে আকাক্সক্ষা করতে হয়। পেট ভরাতে হবে। এ শেখাবার জন্যে বেশী সাধনা দরকার নেই; কিন্তু পুরোপুরি মানুষ হতে হবে এই শিক্ষার জন্যে যে অপরিমিত আকাক্সক্ষার দরকার তাকেই শেষ পর্যন্ত জাগিয়ে রাখবার জন্যে মানুষের শিক্ষা।”৪ ১৭ বছরের এক সিলেটি কিশোর সে বক্তব্য শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলো, ‘আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করতে হলে কী করা প্রয়োজন?’ রবীন্দ্রনাথও উত্তর দিয়েছিলেন। এরপর তৈরি হলো গুরু-শিষ্য যোগাযোগে নতুন ইতিহাস। সেই অনুসন্ধিৎসু কিশোরটি ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী, যিনি শান্তি নিকেতনে কলেজ পর্যায়ে (১৯২১ সালে সেই ছাত্র শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন) প্রথম বিদেশী’ ছাত্র ও পরে শান্তি নিকেতনে-বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন কয়েক বছর। সভাশেষে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ অপূর্বচন্দ্র দত্তের আতিথ্যগ্রহণ করে তার বাসায় (মধ্যাহ্ন ভোজ)পদার্পন করেন। পরে শহরের গণমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে রায়বাহাদুর নগেন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাসায় (চা চক্রে) এক প্রীতিসম্মেলনে যোগ দেন। রাত ন-টায় কবির বাসস্থানে এসে মণিপুরী ছেলেমেয়েরা কবিকে রাসনৃত্য দেখায়, কবি খুব মুগ্ধ হন।
➤সফরসূচি
৮ নভেম্বর ১৯১৯ ইংরেজী: পরদিন আট নভেম্বর কবিগুরু সিলেট থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার উদ্দেশ্যে সিলেট ত্যাগ করেন। আর বিমুগ্ধ নয়নে পেছনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকেন তার গুণমুগ্ধরা। সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে কবি সিলেটকে শ্রীভূমি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সুন্দরী শ্রীভূমি কবিতাটি রচনা করে কবি সিলেটবাসীকে তার অন্তরে স্থান দিয়েছিলেন। কবিপ্রণাম’ নামের সুখ্যাত গ্রন্থের সম্পাদক শ্রী নলিনীকুমার ভদ্র তাঁর ‘অবতরনিকা’ নামক সম্পাদকীয় নিবন্ধের শেষাংশে লেখেন- ‘কবির জীবনী থেকে এ তিনটি দিনের কাহিনী (সিলেট ভ্রমণের ৩ দিন) বাদ দিয়ে যদি কোনো শ্রীহট্টের ইতিহাস লেখা হয় তাহলে তা হবে অসম্পূর্ণ। অনাগত যুগে আমাদের ভবিষ্যদ্বংশীয়েরা এ কাহিনী পড়ে গর্ব অনুভব করবে- যদিও ঈর্ষা করবে তারা আমাদের অপরিসীম সৌভাগ্যকে।’৬ সিলেট ভ্রমণের আনন্দ স্মৃতির কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসবিদ ও কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কালিদাস নাগকে ৩ ডিসেম্বর ১৯১৯ সালে এক চিঠিতে লিখেন- ‘আশ্রমে ফিরে এসেছি। পাহাড় (শিলং) থেকে নেমে আসবার পথে গৌহাটি, শিলেট (সিলেট) ও আগরতলা ঘুরে এলুম। বলা বাহুল্য বক্তৃতার ত্রুটি হয়নি। দিনে চারটে করে বেশ প্রমাণসই বক্তৃতা দিয়েছি এমন দুর্ঘটনাও ঘটেছে। এমনতর রসনার অমিতাচারে আমি যে রাজী হয়েছি তার কারণ ওখানকার লোকেরা এখনও আমাকে হৃদয় দিয়ে আদর করে থাকে এটা দেখে বিস্মিত হয়েছিলুম। বুঝলুম কলকাতা অঞ্চলের লোকের মত ওরা এখনো আমাকে এত বেশি চেনেনি ওরা আমাকে যা-তা একটা কিছু মনে করে। তাই সেই সুযোগ পেয়ে খুব করে ওদের আমার মনের কথা শুনিয়ে দিয়ে এলুম।—- (চিঠিপত্র-১২)৫ #পাদটীকা: [১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবকাশ যাপনের জন্য আসামের তৎকালীন রাজধানী শৈলশহর শিলং এলেন। তিনি সিলেট আসার দীর্ঘ অথচ বিকল্প পথ গৌহাটী থেকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লামডিং-বদরপুর সেকশন হয়ে করিমগঞ্জ-কুলাউড়া হয়ে সিলেট পৌছানোর পথে সিলেট আসতে রাজী হন।৩১ অক্টোবর কবিগুরু শিলং থেকে গৌহাটী অভিমূখে যাত্রা করেন। সেখানে কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়।গৌহাটীতে দিন তিনেক অবস্থান করে কবি ৩ নভেম্বর গৌহাটী থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। গৌহাটী থেকে সিলেটের পথে প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই কবিকে এক পলক দেখার জন্য ভক্তদের ভিড় লেগে যায়। সিলেট থেকে একটি প্রতিনিধিদল কবিগুরুকে এগিয়ে আনতে বদরপুর পর্যন্ত যায়।৪ নভেম্বর ট্রেন কুলাঊড়া জংশনে পৌছালে তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়। কবি ও তার সহযাত্রীরা কুলাউড়াতে রাত্রিযাপন করেন।] ➤লেখক: এস এম শাহনূর কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক তথ্য ঋণ: [১] ভুঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত।।বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা। (বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত) [২] সিলেটে রবীন্দ্রনাথ/সুমন বণিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৭ জানুয়ারি ২০২০ [৩] কবিগুরু সিলেটে পদার্পণের ৯৯ বছর, সিলেট ভয়েজ ৬ নভেম্বর ২০১৮ [৪] আমাদের কালের কথা।। সৈয়দ মুর্তজা আলী [৫] শ্রীভূমি সিলেটে রবীন্দ্রনাথ।।নৃপেন্দ্রলাল দাশ [৬] কবি প্রণাম – ১৯৪১ সালে জামতলা বানীচক্র ভবন সিলেট থেকে প্রকাশিত [৭] রবীন্দ্র জীবনী (৩য় খণ্ড) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় [৮] আত্মকথা – সৈয়দ মোস্তফা আলী। [৯] মণিপুরি শিল্প-সংস্কৃতির প্রসার এবং রবীন্দ্রনাথ -কুঙ্গ থাঙ । অন্য আলো, সিলেটে রবীন্দ্রনাথের আগমনের শতবর্ষ। [১০] শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (পূর্বাংশ) – অচ্যুতচরণ চৌধুরী
আইএনবি/বি.ভূঁইয়া