যুক্তরাষ্ট্র খুনিদের আশ্রয় দিয়ে বসে আছে: প্রধানমন্ত্রী

আইএনবি ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বিভিন্ন দেশে পলাতক জাতির পিতার খুনিদের খোঁজা হচ্ছে । তিনি বলেন, ‘সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, আমেরিকার মতো দেশ সবসময় ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের কথা বলে, ভোটাধিকারের কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে। কিন্তু আমাদের যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছিল, আমরা যে ন্যায়বিচার পাইনি—তারপরে যখন বিচার হলো, সেই খুনিদের আশ্রয় দিয়ে বসে আছে।’

মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) বিকালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড জুডিশিয়ারি’ শীর্ষক বাংলা ও ইংরেজিতে মুজিব স্মারক গ্রস্থ এবং ‘ন্যায়কন্ঠ’ শীর্ষক মুজিববর্ষের স্মরণিকা’র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

তিনি গণভবন থেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের মূল অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের সাহয্যে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।

তিনি সরকারে আসার পর যুক্তরাষ্ট্রে যে ক’জন রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমতায় এসেছেন তাদের কাছে খুনিদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কথা বলেছেন, অনুরোধ করেছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বার বার বলেছি, একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আপনারা কীভাবে আশ্রয় দেন। আপনাদের জুডিশিয়ারি কীভাবে একজন খুনিকে আশ্রয় দেয়?’

আমেরিকায় খুনি রাশেদ এবং কানাডায় মেজয় নূর আশ্রয় নিয়ে আছেন বলেও তিনি জানান।

অন্য সরকারগুলোর মতো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিচার বিভাগে কখনও হস্তক্ষেপ করেনি বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগের অধিকার-উন্নয়নের জন্য বা দেশের মানুষের জন্য কী করেছি সেটা আর আমি এত বেশি বলতে চাই না। তবে আমি এটুকু বলবো, যেহেতু আমার বাবা চাইতেন স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, আমরা সরকারে এসে সেই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করতে বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তার সরকার এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব সুবিধা নিশ্চিত করবে।’ তিনি বলেন, ‘ন্যায় বিচার মানুষের প্রাপ্য। সেটা যেন সব সময় পায় সেটা আমরা চাই। কারণ আমরা ভুক্তভোগী। তাই আমরা জানি বিচার না পাওয়ার কষ্টটা কী।’

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘আমরা যারা ১৫ অগাস্টে সব হারিয়েছিলাম, আমার মতো বাবা মা হারিয়ে যেন কাউকে বিচারের জন্য চোখের পানি ফেলতে না হয়। সেটাই আমরা চাই। সেটা আপনারা নিশ্চিত করে দেবেন। আর আমি যতক্ষণ সরকারে আছি, এর জন্য যা যা দরকার করবো।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কখনও বিচার কাজে হস্তক্ষেপ করিনি। এর আগে অনেক ঘটনা আছে, আপনারা জানেন। দেখা গেছে, ফলস সার্টিফিকেটের ব্যবহার বা ছাত্রদলের কাঁধে হাত রেখে কাকে কী রায় দেওয়া হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ রকম বহু ন্যক্কারজনক ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেছে।’

‘অন্তত আমি এটুকু বলতে পারি আমরা সরকারে আসার পর, সেটা করার সুযোগ নিইনি। সবসময় একটা ন্যায়ের পথে যেন সবাই চলতে পারে, আমরা সেই ব্যবস্থা করেছি।’

স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে টানা তিনবারের সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনারা দেখবেন একের পর এক আমরা কাজ করে গেছি। দ্বিতীয়বার যখন এসেছি, তখন আমরা দ্য কোর্ট অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট-২০০৯ পাস করি এবং বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের স্থায়ী রূপ দিই।’

শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির আজীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরার পাশপাশি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিয়োগান্তক অধ্যায় তুলে ধরে দীর্ঘদিন বিচার না পাওয়ার আক্ষেপ প্রকাশ করেন জাতির পিতার কন্যা।

সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। জাতির পিতাকে হত্যার পর যারা অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিল-তারা তাদের দেশে ফিরতেও বাধা সৃষ্টি করে এবং খুনিদের বিচারের হাত থেকে রক্ষায় ইনডেমনিটি অ্যাক্টও জারি করে। ছয় বছর প্রবাসে জীবন কাটাতে বাধ্য হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে দেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা এবং ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করে জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ সুগম হয়।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আসলে বহু বছর বিচার না পেয়ে মনে অনেক দুঃখ ছিল। যাই হোক, এই হত্যার বিচার পেয়েছি। এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় কথা।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার রায় কার্যকর হওয়ায় বিচার বিভাগ, দল ও দেশবাসীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, তবে এখন আরেকটা দায়িত্ব রয়ে গেছে। চক্রান্তটা খুঁজে বের করা। এটা একদিন বের হবে। এতে কোনও সন্দেহ নেই।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও যেন বিচার বিভাগ স্বাধীনতা অর্জন করে সেই ব্যবস্থাটাও কিন্তু আমি ‘৯৬ সালে এসে করে দিয়েছিলাম। পরে এসে সব রকম সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নিই। এর মাঝে আপনারা জানেন, বিভিন্ন জেলায় বোমা মেরে বিচারকদের  হত্যা করা হয়েছে। সেখানে আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সবসময় বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলতে হবে। আমাদের দেশটাও যেমন বিশ্বে একটা মর্যাদা নিয়ে চলবে, সঙ্গে সঙ্গে একটি দেশের সব অঙ্গও যেন সেভাবে মর্যাদা নিয়ে চলতে পারে, আমরা সেটাই করতে চাই। সেভাবেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

বিচারকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিচারকদের থাকার ব্যবস্থা, চলার ব্যবস্থা; সব ধরনের ব্যবস্থা, সুযোগ সুবিধা আমরা সাধ্যমতো করে দিয়েছি।’

বিচারকদের দক্ষতা বাড়াতে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আইন কমিশন আমরা গঠন করি। বিচারকদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আমি প্রতিষ্ঠা করে দিই। এখন তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ট্রেনিং নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। অন্য দেশে কীভাবে হয় সেটা আমাদের দেশের মানুষের জানা উচিত, সেই ব্যবস্থাটাও আমরা করে দিয়েছি।’

গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ বিচার পায় না। তাদের জন্য লিগাল এইড কমিটি ও আলাদা অর্থ বরাদ্দ করে বিচারের ব্যবস্থাটা আমরা করে দিয়েছি। আইনগত সহায়তা ২০০০ সালে আমরা প্রণয়ন করি।’

অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেখানে মাত্র হাতে গোনা ৭ জনের বেশি বিচারক বসতে পারতেন না, এনেক্স ভবন করে দিয়েছি। ৪০টি চেম্বারের ব্যবস্থা করে দিলাম। পাশাপাশি প্রত্যেকটা জেলা কোর্ট নতুনভাবে গড়ে তোলা হলো। এরপর এসে তো আরও কাজ করে দিয়ে গেছি সেটা আপনারা জানেন। অর্থাৎ মানুষ যেন ন্যায় বিচার পায়, সেদিকে লক্ষ রাখা।’

উচ্চ আদালতে নারী বিচারক নিয়োগে নিজের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে যে আইন ছিল সেখানে বিচার প্রক্রিয়ায় নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে না। জাতির পিতা সেই আইন পরিবর্তন করে সুযোগ দিলেন। কিন্তু আমি এসে দেখলাম আমাদের উচ্চ আদালতে কোনও নারী নেই। আমি প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতিকে নারীদের সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করলাম।’  ​

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অ্য্যাপিলেট ডিভিশনের বিচারপতি এবং স্মারক গ্রন্থ এবং স্মরণিকার সম্পাদক মো. নুরুজ্জামান স্বাগত বক্তৃতা করেন। মুজিব স্মারক গ্রন্থ এবং স্মরণিকার ওপর অনুষ্ঠানে ভিডিও ডকুমেন্টারিও প্রচারিত হয়।

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির পিতা ও বঙ্গমাতাসহ ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের সব শহীদ এবং বিজয়ের এই মাসে সব মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন।

সূত্র: বাসস

 

আইএনবি/বিভূঁইয়া