পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে সংস্কারের উদ্যোগ

আইএনবি ডেস্ক:  বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে অপরাধের ধরন পাল্টেছে। প্রযুক্তিগত অপরাধ বাড়ছে। একবিংশ শতাব্দীর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুলিশকে আধুনিক ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া জনবল সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না বাংলাদেশ পুলিশ। মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোর চাহিদা মেটাতে গিয়ে জেলা শহরগুলোতে দিন দিন পুলিশের জনবল সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। জেলা পর্যায়ে কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী বা ধর্মীয় উগ্রপন্থি রাজনৈতিক দল পরিকল্পিতভাবে অরাজকতা সৃষ্টি করলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ে।

অনেক সময় এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পাশের জেলা থেকে জরুরিভাবে পুলিশ ডেকে আনা হয়। ততক্ষণে যা ঘটার তা কিন্তু ঘটে যায়। এছাড়া বেশিরভাগ থানায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে। সিংহভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপে দুর্বল চার্জশিট দিতে হচ্ছে। মামলা গ্রহণ কিংবা সাধারণ ডায়েরি করতে তাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে নেতাদের কথার বাইরে গিয়ে মামলা কিংবা জিডি করলে উল্টো বিপদে পড়তে হয়।

পুলিশে যানবাহন ও আবাসন সংকটও প্রকট আকার ধারণ করেছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপরাধের ধরন ও তা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পুলিশে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর এজন্য পুলিশে সংস্কার জরুরি। পুলিশে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আমলাদের কাছে নয়, পুলিশের জবাবদিহিতা থাকবে জনপ্রতিনিধিদের কাছে। এদিকে আর্মড ফোর্সেস বিভাগের মতো পুলিশের জন্য পৃথক বিভাগ গঠনের দাবি জানিয়েছেন পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা। পুলিশ বিভাগ গঠন হলে নিয়োগে কালক্ষেপণ থাকবে না। জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ দ্রুত নেওয়া সম্ভব হবে। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হলে ফাইল মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয়, ২৬ জনের স্বাক্ষর লাগে। সেটি সম্পন্ন হতে যত সময় লাগে তাতে জরুরি বিষয়টি দ্রুত করা সম্ভব হয় না। পুলিশে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি শক্তিশালী চক্রের হাতে জিম্মি। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতা ও সততার ভিত্তিতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ফাইল যখন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, তখন সেই সুপারিশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়ে যায়। সুযোগ পায় অদক্ষ, অযোগ্য, দলবাজ, তদ্বিরবাজরা। তাদের অভিজ্ঞতা হলো তদ্বির আর মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন। কিন্তু পুলিশের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে অযোগ্যদের প্রাধান্য পাওয়া মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। এতে দুর্নীতিকে উত্সাহিত করা হয়।

পুলিশের কাজ জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। র্যাংক অনুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তারা অধীনস্থদের তদারকি করবে। এখানে পেশাদারিত্বকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পুলিশে সংস্কার এখন সময়ের দাবি। নতুন নতুন অপরাধ মোকাবিলায় পুলিশকে আরো আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে। কিন্তু পুলিশে সংস্কার হচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরে। পুলিশ বাহিনীর সাবেক প্রধান থেকে শুরু করে বর্তমানে কর্মরত অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে পুলিশের সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। পুলিশের জন্য পৃথক বিভাগ চালু হলে এই বাহিনীটির সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ হয় ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে যাতে অংশ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দমনমূলক মানসিকতা ত্যাগ করে সেবার মনোভাব নিয়ে মানুষের কল্যাণে পুলিশকে কাজ করার তাগিদ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপর কেটেছে চার দশকের বেশি সময়। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অন্যতম প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনী পুলিশ। ১৮৬১ সালের ‘পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল’—পিআরবিকে ভিত্তি করেই চলছে এই বাহিনী। যদিও পুলিশের সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বারবারই। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি এখনো। পুলিশে পৃথক বাহিনী গঠন হলে এই বাহিনীতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মন্ত্রী এমপি বা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির টেলিফোন কিংবা লিখিত বা মৌখিক সুপারিশ আর কার্যকর হবে না। এক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে। এতে একদিকে পুলিশের জবাবদিহিতা বাড়বে অপরদিকে পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কমবে অনেকটাই। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘যারা রাষ্ট্রের নীতিগুলো নির্ধারণ করছেন তাদের বোঝা এবং বুঝে নতুন আইন করে পুলিশ সিস্টেম প্রবর্তন করা যাতে করে জনগণকে সেবা দেওয়া যায়।’ পুলিশের সাবেক একজন মহাপরিদর্শক বলেন, পুলিশে সংস্কারের তাগিদ অনুভব করছেন তারাও।

চলমান করোনা দুর্যোগের মধ্যে পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। যেখানে স্ত্রীর লাশ স্বামী-সন্তানরা নিতে চান না, স্বামীর লাশ ফেলে স্ত্রী-স্বজনরা পালিয়ে যান, সেখানে পুলিশ করোনায় মৃতদের লাশ দাফন পর্যন্ত করেছেন। স্বাস্থ্য ঝুঁকি সত্ত্বেও ফ্রন্টলাইনার হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন পুলিশ সদস্যরা। এছাড়া অসহায় মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন তারা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মাস্ক ব্যবহারের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে পুলিশ।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকাও প্রশংসিত হয়েছে। লাইবেরিয়ায় পুলিশ সংস্কারের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের পুলিশ যা ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশের মতো দক্ষ ও অভিজ্ঞ পুলিশ বিশ্বের কোথাও নেই। এছাড়া জঙ্গি দমনে পুলিশের ভূমিকাও প্রশংসিত হয়েছে সারা বিশ্বে। ইন্টারপোল বাংলাদেশ থেকে দুই জন পুলিশ সদস্যকে নিয়েছে জঙ্গি দমনে তাদের অভিজ্ঞতা জানতে। তবে কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশে পুলিশের সংস্কার ব্যাহত হচ্ছে। লাইবেরিয়ায় সাফল্য পেলেও বাংলাদেশে একই পন্থা অবলম্বনের সুযোগ খুব কম পায় পুলিশ।

এদিকে ভালো কাজের মধ্যেও পুলিশের কিছু সদস্য বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত। নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতাকে প্রাধান্য না দেওয়ায় সেখানে লেনদেন গুরুত্ব পাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের কোনো কোনো রেঞ্জে মাসে কয়েক কোটি টাকার ঘুষ আসে। এসপি ও ওসি বদলি টাকা ছাড়া হয় না। আর ঘুষের টাকা উঠাতে গিয়ে তারা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশ মানুষের ২৪ ঘণ্টা জানমালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত। কিন্তু পুলিশে রয়েছে যানবাহনের সংকট, বাসস্থানেরও অভাব। বেতনও কম। তারপরও ২৪ ঘণ্টা বিরতিহীন সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।

পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে পুলিশের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ সার্বিক সুযোগ-সুবিধা অনেক বাড়িয়েছে, যার সুফলও পাচ্ছে জনগণ। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ৯৬টি থানা রিমোট কন্ট্রোল মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। একটি রুমে বসে ২৪ ঘণ্টা প্রতিটি থানা মনিটরিং করা হচ্ছে। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান এই কাজটি করেছেন। এর আগে এই কার্যক্রম পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ উদ্বোধন করেন। সফলভাবে এ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় ঢাকা রেঞ্জের ৯৬ থানায় দুর্নীতি ও হয়রানি শূন্যের কোঠায় চলে আসছে বলে কর্মকর্তারা জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, পুলিশের পুরো সংস্কার করা জরুরি। আধুনিক যুগে অপরাধ বিষয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুলিশের বিভিন্ন বিভাগকে বিকেন্দ্রীয়করণ করতে হবে। নতুন নতুন স্পেশালাইজড ইউনিট চালু করার পাশাপাশি গবেষণার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। ‘৯৯৯’ পুলিশের বিরাট একটা সেবামূলক কার্যক্রম। এই ধরনের কার্যক্রম আরো বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ১৮৬১ সালের আইন দিয়ে পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। আধুনিক যুগে পুলিশে দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে হবে। তিনি বলেন, পুলিশে যানবাহনসহ অন্যান্য সমস্যা দূর করতে হবে। আসামি রাখাসহ সব ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সম্ভব হবে না।

পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, পুলিশে সংস্কার করতে গিয়ে নিয়োগ ও বদলির জন্য পুলিশ কমিশন গঠন এবং পুলিশ কমপ্লেন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সাবেক বিচারপতিদের দিয়ে এই কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এতে পুলিশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিঞা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত করলে তা নিরপেক্ষ হয় না। তাই পুলিশে কমিশন গঠন করা জরুরি যারা এ জাতীয় তদন্ত করবে। পুলিশের সাবেক আইজি শহিদুল হক বলেন, ২০০৮ সালে পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার পর পরবর্তী সময়ে সব আমলা এক জোট হয়ে সেই প্রস্তাব আর বাস্তবায়ন করেননি।

এদিকে পুলিশকে জনগণের প্রথম ভরসাস্থল হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে গত বছরের ১৫ এপ্রিল পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. বেনজীর আহমেদ। ৩৭তম আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি যেন হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ পুলিশের ‘চেঞ্জ মেকার’। বাংলাদেশ পুলিশের আইজি হিসেবে ড. বেনজীর আহমেদের দুর্দান্ত নেতৃত্বের দুরন্ত প্রথম বছরে বিস্ময়কর উদ্যোগ ও অর্জন সাধিত হয়েছে। পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর জনতার পুলিশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ড. বেনজীর আহমেদ পাঁচটি মূলনীতি ঘোষণা করেন। সেগুলো হলো—দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ গড়া, পুলিশকে মাদক মুক্ত করা, নির্যাতন মুক্ত পুলিশিং ব্যবস্থা, বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে পুলিশি সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া এবং পুলিশ সদস্যদের শৃঙ্খলা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। বেনজীর আহমেদ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের প্রতিটি শাখার জন্য সুনির্দিষ্ট এওআর প্রণয়ন এবং কর্মবণ্টন করেছেন। তিনি পুলিশের সব সদস্যের জন্য একই সিরিয়ালের (০১৩২ সিরিয়াল) মোবাইল ফোন নম্বর চালু করেন। এছাড়া তিনি পুলিশে নিয়োগ, বদলি পদোন্নতিতে অস্বচ্ছতা দূর করতে যুযপোযোগী পরিবর্তন আনেন।
ইত্তেফাক

আইএনবি/বিভূঁইয়া