একটি রাস্তা ও বদলে যাওয়া সাজেক

সাজেকে ভ্রমণপিপাসু ও স্থানীয়দের উচ্ছাস

আসাদুজ্জামান আজম, রাঙামাটি (সাজেক) থেকে ফিরে :

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর রাঙামাটির সাজেক। পাহাড়, মেঘ আর সবুজের অভয়ারণ্য। মেঘ-পাহাড়ের রাজ্যের প্রকৃতির এ রূপকে মনভরে উপভোগ করতে দেশ-বিদেশের ভ্রমণপ্রেমীর নজর এখন সাজেক। রাঙামাটির জেলার শেষ প্রান্তে ভারতের দু’টি রাজ্যের সীমানা ছুঁয়েছে সাজেক।

সাজেক ভ্যালি রাঙামাটি জেলার উত্তরের মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত। মেঘকে হাতের মুঠোয় ছুতে, পাহাড়ের সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করতে প্রতিদিনই অসংখ্য পর্যটকের ছুটে আসেন। পাহাড়ে পাহাড়ে গড়ে উঠা ১৮৪টি গ্রাম নিয়ে সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত।

সেখানে দুটি শাসনব্যবস্থা বা পদ্ধতি চলে। একটি হলো সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদ, আরেকটি স্থানীয় রাজার পদ্ধতি। গোটা পার্বত্য এলাকার মতো সাজেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলাসহ উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

অসংখ্য পাহাড়, পর্বতে আবর্ত সাজেক যেনো বিচ্ছিন্ন কোনো মানববসতি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন, যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। যা স্বপ্নের দেশ সিঙ্গাপুরের চেয়েও বড়। বাংলাদেশের একটি জেলার সমান। রুইলুইপাড়া, হামারিপাড়া এবং কংলাকপাড়া নিয়ে সাজেক। সাজেকজুড়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস।

সাজেকে মূলত লুসাই, পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা উপজাতি বসবাস করে। পাহাড়ি এই জনপদের বেশির ভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। তাদের জীবিকার প্রধান উৎস কৃষিকাজ। আগে সবাই জুমচাষ করতো। এখন মিশ্র ফলচাষে অনেকে স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে। গোটা সাজেকে নেই অবকাঠামোগত সুবিধা। সেখানকার ১৮৪টি গ্রামই বিচ্ছিন্ন। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে গ্রামে যেতে হলে তিন দিনও পার হয়ে যায়।

পায়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা সেখানে দুষ্পাপ্য। বাঘাইহাট উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। সেখানে পাহাড়ে বসবাসরতদের পক্ষে যাওয়া অনেকটাই অসম্ভব।

পুরো ইউনিয়নে সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩৫টি। যেখানে চার থেকে পাঁচটি গ্রামের শিশুদের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে হয়। কলেজ না থাকায় উচ্চশিক্ষায় যেতে হয় ৭০ কিলোমিটার দূরত্বের রাঙামাটি জেলা শহর অথবা খাগড়াছড়িতে।

গোটা এলাকায় রয়েছে সরকারিভাবে একটি উ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় সেখানেও চিকিৎসা নিতে পারে স্থানীয়রা। অনেক সময় মুমূর্ষু রোগীদের হেলিকপ্টারে করে চিকিৎসার জন্য অন্যত্র নিতে সাহায্য করে সেনাবাহিনী।

সূত্র মতে, সাজেকের উন্নয়নের বিষয়ে অনেকটা বাধা স্থানীয়রা। উন্নয়নের ব্যাপারে তারা উদাসীন। স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের বিরোধিতা কারণেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হচ্ছে না। তারা উন্নয়নবিরোধী। শিক্ষার প্রতিও আগ্রহ নেই স্থানীয়দের।

শিক্ষার্থী সংকটে অনেক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। পড়াশোনার চেয়ে বাচ্চাদের নিয়ে কৃষিসহ নানা কাজ করাকেই বেশি লাভজনক মনে করেন এলাকার লোকজন। তাই শিক্ষার্থীর অভাবে অনেক স্কুলে পাঠদানের অনুমতি বাতিলও হয়েছে।

একটি রাস্তা ও বদলে যাওয়া সাজেক : এত সমস্যার পর সারা দেশের মানুষের কাছে পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় কেন্দ্র অপার সৌন্দর্যের আঁধার সাজেক ভ্যালি। ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি সফরে এসে সাজেক আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

হেলিকপ্টারে তিনি সাজেকের বিজিবির বিওপি ক্যাম্পে নামেন। সেখানে সামরিক বাহিনীর একটি দরবারে অংশ নেন। দরবার শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাংখোয়া, ত্রিপুরা ও লুসাই জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।

এসময় তিনি সাজেকের প্রাকৃতিক রূপে মুগ্ধ হয়ে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে দীঘিনালা, বাঘাইহাট হয়ে রুইলাকপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনী। সড়কটির শেষ প্রান্ত মিলেছে কংলাক পাহাড়ের তলদেশে। রুইলুই এবং কংলাক দুটি পাড়ার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সাজেক ভ্যালি।

১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত রুইলুই পাড়া এক হাজার ৭২০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। আর কংলাক পাড়া এক হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। রাঙামাটির অনেকটা অংশই দেখে যায় সাজেক ভ্যালি থেকে। এ জন্য সাজেক ভ্যালিকে রাঙামাটির ছাদ বলা হয়।

এই একটি মাত্র সড়ক সাজেক ভ্যালিকে সংযুক্ত করেছে সমতল ভূমি থেকে। বাঘাটহাট থেকে পুরো সড়কটিরই ঝুঁকিপূর্ণ। আঁকাবাঁকা আর উঁচু-ঢালু। এক পাহাড় থেকে নেমে আরেক পাহাড়ে উঠতে হয়, এভাবেই পৌঁছতে হয় এক হাজার ৭২০ ফুট উচ্চতার রুইলুইপাড়ায়।

হেলিকপ্টারে যাতায়াতের সুবিধার্থে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়ে হেলিপ্যাড। সড়কটিই যেনো এখন সাজেকের প্রাণ। সড়কটির ঘিরে অসংখ্য স্থানীয় বাসিন্দা জীবিকা নির্বাহ করছেন। পথিমধ্যে গড়ে উঠেছে কয়েকটি স্থানীয় বাজার।

পর্যটকসহ স্থানীয়দের নিরাপত্তায় পুরো সড়কে সেনাবাহিনী ও বিজিবির নজরদারি রয়েছে। ১০ নং বাঘাইহাট পুলিশ ও আর্মি ক্যাম্প থেকে ভ্রমণরত সদস্যদের তথ্য দিয়ে সাজেক যাওয়ার মূল অনুমতি নিতে হবে।

একে আর্মি এসকর্ট বলা হয়। আর্মিদের পক্ষ থেকে গাড়িবহর দ্বারা পর্যটকদের গাড়িগুলোকে নিরাপত্তার সাথে সাজেক পৌঁছে দেয়া হয়। দিনের দুটি নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত আর্মি ক্যাম্পের পক্ষ থেকে সাজেক যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না।

মেঘে ঢাকা সাজেক ভ্যালির অপরূপ রূপ : খাগড়াছড়ি শহর অথবা দীঘিনালা থেকে স্থানীয় গাড়িতে (জিপ গাড়ি, সিএনজি, মোটরসাইকেল) করে সাজেকে যাওয়াই হচ্ছে বর্তমানে সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় মাধ্যম। সাজেকের বিজিবি ক্যাম্প বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উঁচুতে অবস্থিত বিজিবি ক্যাম্প।

সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিজিবিও সুষ্ঠু পরিকল্পনায়, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে সাজেকে ভ্রমণরত পর্যটকদের জন্য প্রায় সকল ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সারা বছরই সাজেক যাওয়া যায়। আর সাজেকে পাহাড়ধস বা রাস্তাধস এরকম কোনো ঝুঁকি নেই।

সাজেক ভ্যালির উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা অবস্থিত। সাজেক ভ্যালিতে সর্বত্র মেঘ, পাহাড় আর সবুজ। এখান থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যায়। সাজেকের রুইলুইপাড়া থেকে ট্রেকিং করে কংলাকপাহাড়ে যাওয়া যায়।

কংলাক হচ্ছে সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া। কংলাকে যাওয়ার পথে মিজোরাম সীমান্তের বড় বড় পাহাড়, আদিবাসীদের জীবন যাপন, চারদিকে মেঘের আনাগোনা দেখা যায়। এখানে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে উপজাতীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং তাদের সংস্কৃতির নানা উপকরণ উপভোগ করা যায়।

সাজেক ভ্যালিতে রয়েছে বিভিন্ন মানের পাহাড়ি রেস্তোরাঁ ও কটেজ। মনোমুগ্ধকর অত্যাধুনিক দুটি রিসোর্ট নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনী। দুটিতেই রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ সুবিধা। বদলে যাওয়া সাজেকের জনজীবনে এসেছে পরিবর্তন। স্থানীয় লুসাই ও ত্রিপুরাদের ভাগ্য বদলে গেছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে নানা রকম ক্ষুদ্র ব্যবসায় সম্পৃক্ত তারা।

খাবার হোটেল, কটেজ, ফল দোকান, পাহাড়ি গৃহস্থালি সামগ্রী বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে তারা। রাতের সাজেক অনেক সুন্দর। রাত হলেই কংলাক ও রুইলুইপাড়ায় জ্বলে বিদ্যুতের বাতি। বর্তমান সরকারের মেয়াদে সাজেকবাসীর প্রতি এটি সেরা উপহার।

সন্ধ্যার পর হেলিপ্যাডসহ গোটা পাড়ায় পর্যটক ও স্থানীয়রা গান-বাজনাসহ নানা রকম আনন্দে মেতে উঠে সবাই। সাজেকের বেম্বো টি, বেম্বো চিকেন, বেম্বো বিরিয়ানি খুবই সুস্বাদু এবং বিখ্যাত। রাত বাড়ার সঙ্গে কটেজের বেলকনিতে দোল খেতে শুরু করে মেঘ।

মনে হবে— যেনো মেঘের ভেলায় বসে আছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলে তাকালেই মনে হবে, মেঘের চাদর ঢেকে রেখেছে সাজেক। সন্ধ্যায় কংলাকপাহাড় অনেক সুন্দর। মনে আকাশের ডুবন্ত সূর্য আপনাকে পাশ কেটে যাচ্ছে। সেখানেও রাত কাটানোর জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কিছু কটেজ। পাওয়া যায় নানা স্বাদের স্থানীয় খাবার।

সাজেকে পানি সংকট তীব্র। পানি নেই বললেই চলে। খাবার পানি হিসেবে বোতলজাত পানির ব্যবহার বেশি। প্রায় এক হাজার ফুট নিচ থেকে চান্দেরগাড়িতে টাংকি বসিয়ে পানি তোলা হয়। যার কারণে সাজেকে আগতদের পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে পরামর্শ দেয়া হয়। পানি সংকটের কারণেই সাজেক ভ্যালি খাবার এবং কটেজের রুম ভাড়া অনেকটা বেশি বলে স্থানীয় জানান।

স্থানীয় রাজার প্রতিনিধি বা রুইলুইপাড়া হেডম্যান লাল খাংয়া লুসাই জানান, আগে নিজ পরিবারের খাবার (চাল, ডাল) আনতে দুইদিন হেঁটে বাজারে যেতে হতো। কয়েকদিন পর আবার যেতে হতো। এভাবেই আমরা চলতাম। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী আসার পরে আমাদের পরিবর্তন এসেছে। এখন রাস্তা হয়েছে, বিদ্যুৎ এসেছে। পর্যটক আসায় পাড়ার সবাই অর্থনৈতিকভাবে ভালো আছে। পর্যটকরা আমাদের মেহমান।

সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা (নয়ন চাকমা) বলেন, সাজেকের উন্নয়নের ব্যাপারে সরকার, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পাবর্ত্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সাংসদ, আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করছি। পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়ায় দুর্গম এলাকায় উন্নয়ন করা কঠিন। তবে কিছুদিন আগে পরিষদ ভবনের কাজ শেষ হয়েছে, উন্নয়ন শুরু হয়েছে, আগামীতে আরও উন্নয়ন হবে।

এসটিএ/এএ