আইএনবি ডেস্ক:বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জোট সরকারের আমলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। আগামী নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি হাসান শিপলু
কালের কণ্ঠ : অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাসের মূল্যায়ন কিভাবে করবেন?
ইকবাল হাসান টুকু : আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক হয়নি। ট্রাফিক সিস্টেম পুরোপুরি কার্যকর নয়।
বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই। মূল্যস্ফীতি বড় সমস্যা। এসব সমস্যার সমাধান না করে নানা কথাবার্তা চলছে। সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা আছে।
সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে অপপ্রচার ভারত চালাচ্ছে, তার জবাবও সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে না। সব কিছু মিলিয়ে সর্বত্র এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। এই হতাশা কাটানোর দায়িত্ব সরকারের।
কালের কণ্ঠ : আপনারা নির্বাচনের আগে জরুরি সংস্কারের কথা বলছেন। কোন কোন সংস্কার করে সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত?
ইকবাল হাসান টুকু : সুষ্ঠু ভোটের জন্য যা যা করা দরকার, শুধু সেই সংস্কার করতে হবে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। যারা গত তিনটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের বাদ দিতে হবে। নতুন লোকদের দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বৈষম্যবিরোধী ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ঘোষণাপত্র কিভাবে দেখছেন? বিএনপির অনেকে বলে আসছেন, ’৭১ আর ’২৪কে এক করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইকবাল হাসান টুকু : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ না হলে বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলে একটি ভূখণ্ড পেয়েছিলাম আমরা। বাংলাদেশ না হলে তো ’২৪ সাল আসত না। সুতরাং ’২৪ সালের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে তুলনা করা একটি অপরিপক্ব চিন্তার ফসল।
কালের কণ্ঠ : বিএনপির কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা বলেছেন, জামায়াত ’৭১ সালকে ’২৪-এর সঙ্গে তুলনা করছেন?
ইকবাল হাসান টুকু : মানুষের ভেতরে যখন গর্ব করার কিছু থাকে না তখন তারা অন্য কিছু খুঁজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত বিরোধিতা করেছে। এ জন্য তারা ক্ষমাও চায়নি এখন পর্যন্ত। তারা যদি এসব কথা বলে, এটি একটি স্বপ্ন দেখার মতো।
কালের কণ্ঠ : আপনি তো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ’৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও ’২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ইকবাল হাসান টুকু : আজকে যুবকদের স্মৃতি অন্তরে ২০২৪ সাল বড় একটি জায়গায়। ’৭১ সালে তো আমরা তরুণ ছিলাম। আমাদের অন্তরে ’৭১ সাল হলো গর্ব। এই গর্বের জায়গায় কেউ আঘাত করতে চাইলে প্রতিবাদ করব।
কালের কণ্ঠ : হঠাৎ বিএনপি জামায়াতের মধ্যে বাগযুদ্ধ দেখা যাচ্ছে। দুই দলের মধ্যে সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে আছে?
ইকবাল হাসান টুকু : বিশ্বে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে জেতার জন্য অনেক ধরনের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়। তেমনি ২০০১ সালে পরিকল্পনা করেছিলাম জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচন করব। জামায়াতের নীতি আলাদা, আমাদের নীতি আলাদা। আমাদের মধ্যে বড় ধরনের বিভাজন আছে। নীতিগতভাবেই তো জামায়াতের সঙ্গে আমাদের অনেক দূরত্ব।
কালের কণ্ঠ : আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে কি নির্বাচনী জোট হতে পারে?
ইকবাল হাসান টুকু : রাজনীতিতে কেউ স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু না। ভোটের সমীকরণে অনেক কিছু করতে হয়।
কালের কণ্ঠ : নির্বাচন ২০২৬ সালে হলে আপনাদের আপত্তি থাকবে?
ইকবাল হাসান টুকু : নির্বাচন দেরি করার কোনো কারণ দেখি না। ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। সব রাজনৈতিক দল এ দাবিতে একমত হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে আছে বলে মনে করেন?
ইকবাল হাসান টুকু : গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে ভারত বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে ভারতবিরোধী করে তুলেছে। এ জন্য দায়ী মোদি সরকার, ভারতের জনগণ নয়। এখন এমন অবস্থায় যে মোদি সরকার তাদের মিডিয়াকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে ভারত সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন কেমন?
ইকবাল হাসান টুকু : আমরা ভারতবিরোধী নই, আমরা জাতীয়তাবাদী শক্তি। আমার দেশের স্বার্থহানি ঘটলে তা নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করব। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, তারপর খালেদা জিয়া তা-ই করেছেন। আমরাও তা-ই করছি।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রেষারেষির কারণে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সুযোগ কি তৈরি হতে পারে?
ইকবাল হাসান টুকু : এটি কোনো দলের বিষয় নয়, জনগণের বিষয়। আওয়ামী লীগ ঘৃণ্য কাজ করে দেশ ধ্বংস করেছে। আমি মনে করি না আওয়ামী লীগ চাইলেই এসে নেমে পড়তে পারবে। সম্ভব না।
কালের কণ্ঠ : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বৈঠককে কিভাবে দেখছেন?
ইকবাল হাসান টুকু : এটা সাধারণ শিষ্টাচার। আগের সেনাপ্রধানরা করেননি, যা শিষ্টাচারবহির্ভূত ছিল।
কালের কণ্ঠ : সিভিল প্রশাসন নিয়ে আপনাদের অভিযোগ কেন?
ইকবাল হাসান টুকু : প্রশাসন থেকে দোসরদের বাদ দেওয়া হয়নি বলে নানা ঘটনা ঘটছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান ও লতিফুর রহমান প্রথম রাতেই প্রশাসন নিরপেক্ষ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তা করেনি। আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত আমলারা শেখ হাসিনাকে দানব বানিয়েছিলেন। তাঁদের এখনো বাদ দেওয়ার সুযোগ আছে। তবে যে সরকারে আলী ইমাম মজুমদারের মতো লোক উপদেষ্টা থাকেন, সেখানে প্রশাসন নিরপেক্ষ করা কঠিন।
কালের কণ্ঠ : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরতে পারেন?
ইকবাল হাসান টুকু : ক্ষেত্র যখন প্রস্তুত হবে, তখন ঠিকই তিনি দেশে ফিরে আসবেন।
কালের কণ্ঠ : ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিল করার জন্য বৈষম্যবিরোধীদের দাবির বিষয়ে কী মনে করেন?
ইকবাল হাসান টুকু : যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শাসনতন্ত্র সংসদে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায়। ’৭২-এর শাসনতন্ত্র যারা তৈরি করেছিল, তারা বাকশাল কায়েম করে তা ধ্বংস করেছিল, সেটা অপ্রয়োজনীয় ছিল। জিয়াউর রহমান এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। শেখ হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনী করেছিলেন, সেটা অপ্রয়োজনীয় ছিল বলে তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং শাসনতন্ত্র তো দোষ করেনি, দোষ করেছে যাঁরা অপ্রয়োজনীয় সংশোধনী করেছিলেন তাঁরা। এর থেকে বড় দাবি ছাত্ররা করতে পারত যে ’১৪, ’১৮ ও ’২৪ সালের সংসদ নির্বাচন বাতিলের দাবি তুলতে পারত। তাহলে এই তিন সংসদে যেসব আইন পাস করেছিল, সবই বাতিল হয়ে যেত। তা না করে সংবিধান বাতিল করে লাভ কী?
কালের কণ্ঠ : বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্ররা নতুন দল গঠনের উদ্যোগকে কিভাবে দেখছেন?
ইকবাল হাসান টুকু : যে কেউ নতুন দল করতে পারে। আমি ছাত্রদের স্বাগত জানাই।
কালের কণ্ঠ : সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা দল করছে বলে অভিযোগ আছে? তাহলে এটি কি কিংস পার্টি হবে?
ইকবাল হাসান টুকু : অবশ্যই, এটা বলার কোনো অপেক্ষা রাখে?
কালের কণ্ঠ : বৈষম্যবিরোধীরা তো বিএনপিকে কিংস পার্টি বলছে?
ইকবাল হাসান টুকু : বিএনপি কিংস পার্টি হলে তো এত বড় দল হতে পারত না। তখন দেশের প্রয়োজনে জিয়াউর রহমান দল গঠন করেছিলেন। দল গঠনের আগেই জিয়াউর রহমান সবার নেতা হয়ে গিয়েছিলেন।
কালের কণ্ঠ : বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্ররা নতুন দল গঠন করলে তাদের সঙ্গে কী বিএনপির নির্বাচনী জোট হতে পারে?
ইকবাল হাসান টুকু : রাজনীতিতে কে কখন কার বন্ধু হয়ে যায়, তা বলা কঠিন। নির্বাচনী কৌশলে যদি হয়, জোট হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ইকবাল হাসান টুকু : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।
আইএনবি/বিভূঁইয়া